সেদিন লেকচার ক্লাসে কামরুল স্যার বেশ ভারী ভারী টপিকে কথাবার্তা বলছিলেন। সকাল থেকে ক্লাস শুরু হয়ে দুপুর গড়িয়ে যাওয়ায় পেছনের সারিতে বসে আমরা কয়েকজন খুব ঝিমুচ্ছিলাম। পাশের বেঞ্চে আলামিন তো ঘুমিয়েই গেছে!
স্যার ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন। আফসোসের সুরে আমাদেরকে নসিহত করার উদ্দেশ্যে নিজের প্রতিদিনকার রুটিনটা আমাদের সামনে তুলে ধরলেন পঞ্চাশোর্ধ জেন্টলম্যান ডা. কামরুল স্যার..
ফজরের আগে উঠে কিছু সময় ইবাদাতের পর ফজরের সালাত আদায় করেই রমনা পার্কের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান তিনি। এরপর পার্কে কমপক্ষে দুইটা চক্কর দিয়ে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরেই বেরিয়ে পড়েন নিজের কর্মস্থল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। হাসপাতালে এসে তো বসার সময় নেই.. রোগীদের ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে হয়। রাউন্ড শেষ করেই দৌড়ে চলে আসেন লেকচার গ্যালারিতে, আমাদের ক্লাস নিতে।
ক্লাস শেষ করে আবার বেরিয়ে পড়েন নিজের চেম্বারের উদ্দেশ্যে। রাত অবধি রোগী দেখে বাসায় ফিরবেন। তবে রাতের শিডিউলটা খুব দ্রুতই শেষ করেন স্যার। সাড়ে দশটার মধ্যেই রাতের খাবারসহ সবকিছু ক্লোজ করে বিছানায় চলে যান, এরপর আবার শেষ রাতে উঠা।
এত এত পরিশ্রমের পরেও তার চোখে ক্লান্তির ছিটেফোঁটাটুকুও নেই, আর আমরা এই বয়সেই..
স্যারের সাথে সাথে নিজেদের দুর্দশার কথা চিন্তা করে আমার নিজেরও আফসোস হচ্ছিল। পাশের বেঞ্চে আলামিন তখনো ঘুমোচ্ছে, পেট বরাবর হালকা গুঁতো দিয়ে ব্যাটাকে জাগিয়ে দিলাম।
বন্ধুরা! তোমরা নিশ্চয়ই আমাদের মতো এত অলস নও, বরং কামরুল স্যারের মতোই কর্মচঞ্চল। তবে মাঝেমধ্যে হয়তো কিছুটা আলসেমি চলেই আসে, না কি?
আচ্ছা, ভালো কথা! কামরুল স্যারের এই কর্মচাঞ্চল্যের পেছনে তোমরা কী কী বিষয় অনুধাবন করতে পেরেছ? আমি তিনটি বিষয় আইডেন্টিফাই করতে পেরেছি-
১. শরীরচর্চা
২. পর্যাপ্ত ঘুম
৩. পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ
স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল পেতে হলে এই তিনটি মূলনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর আমাদের ছোট পরিসরে আজকের আলোচনার টপিক হলো- শরীরচর্চা।
শরীরচর্চা মানেই কিন্তু জিমে ভর্তি হয়ে ভারোত্তোলন করে নিজেকে ‘সিক্স প্যাক হিরো’ বানিয়ে ফেলা নয়। বরং সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রতিদিনই কিছু না কিছু শারীরিক মুভমেন্ট করা প্রয়োজন। আমি সে আলোকেই তোমাদের সামনে কিছু কথা বলে যাই..
প্রথমত, আমরা জেনে নিই শরীরচর্চা আসলে কেন দরকার? এর উপকারিতা কতটুকু?
এক কথায় বলতে গেলে শারীরিকভাবে তো বটেই মানসিকভাবে সুস্থ এবং সুখী জীবনযাপনের জন্য নিয়মিত শরীরচর্চার বিকল্প নেই।
শারীরিক সুস্থতা :
১. ওজন কমাবে। অতিরিক্ত ওজন একাই অনেকগুলো রোগের ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। তাই নিশ্চিতভাবেই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা মানে অনেকগুলো সমস্যা থেকে বেঁচে যাওয়া।
২. হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের সুস্থতার জন্য জরুরি, এমনকি হজমের জন্যেও সহায়ক।
৩. হাড় ও পেশী সুগঠিত ও সক্রিয় করার মাধ্যমে শরীরকে করে প্রো-একটিভ।
৪. ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, এমনকি ক্যানসারের মতো সমস্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
মানসিক সুস্থতা :
১. সম্প্রতি প্রমাণিত হয়েছে, পরিমিত ব্যায়াম মস্তিষ্কের নিউরন সংখ্যা বৃদ্ধি করে!
২. ব্যায়ামের সময় ডোপামিন, সেরেটোনিন, এনডোরফিন হরমোনগুলো বেশি বেশি নিঃসরণ হয়। এগুলো মানসিক প্রশান্তির জন্য সহায়ক।
৩. শরীর ও মন ফুরফুরে থাকার কারণে নিশ্চিন্ত নির্বিঘ্ন ঘুম সহজ হয়। আর অনিদ্রা.. দৌড়ে পালায়!
এখন, কী ধরনের ব্যায়াম করা যেতে পারে সে বিষয়ে কিছু কথা বলি। তোমরা যারা লেখাটি পড়ছ, বেশিরভাগই কিশোর বয়সের। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, যেকোনো কাজই আমাদের সামর্থ্য এবং সীমাবদ্ধতা খেয়াল রেখেই করা উচিত। প্রয়োজনের তুলনায় কম যেমন ভালো নয়, আবার অতিরিক্ত কোনো কিছুও ভালো নয়।
ধরো, তোমার অতিরিক্ত ওজন। এখন এটা কমানোর প্ল্যান তোমার। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হয় একজন ট্রেইনারের গাইডলাইনে থেকে ডায়েট চার্ট মেইনটেন করে উপযোগী ব্যায়ামগুলো করা। জিমে ভর্তি হতে পারো।
আবার কারও শখ বডি বিল্ডিং.. শখ থাকা ভালো, সেটা সমস্যা না। তবে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে শখের পেছনে যেন আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্য না থাকে। হাল আমলের ফিতনায় জড়িয়ে পড়ার আশংকা থাকলে এ ধরনের কাজে না নামাই ভালো।
আর এদিকে যারা আমার মতো অলস.. আলসেমি কাটানো দরকার, শরীরটাকে একটু একটিভ করা দরকার। এরকম যারা আছো তাদের জন্য কিছু পরামর্শ :
১. নিয়মিত ফরয সালাতগুলো মাসজিদে জামাআতে আদায় করা (ছেলেরা), তাহাজ্জুদের সালাতকে নিয়মিত রুটিনের অংশ করার চেষ্টা করা (ছেলেমেয়ে উভয়েই)।
২. প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে অন্ততপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটা। সকালে ফজরের পরের সময়টাই বেশি উপযুক্ত।
যেমন-তেমনভাবে হাঁটলে হবে না, ঘাম ঝরাতে হবে।
[বোনেরা বাড়ির ভেতরে থেকে পর্দা মেইনটেন করে যতটুকু সম্ভব হাঁটাচলা করতে পারে। বিশেষ করে যেসকল বোন পুরোপুরি নিকাব করে তাদের জন্য একটি বিশেষ পরামর্শ- দিনের কিছু সময় (পর্দার অধীনে থেকেই) হাত-মুখে কিছুটা রোদ লাগানো প্রয়োজন। কারণ, আমরা জানি হালকা রোদ শরীরে ভাইটামিন ডি তৈরিতে সহায়ক। আর পর্দানশীন বোনদের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই শরীরে ভাইটামিন ডি এর ঘাটতিজনিত সমস্যা দেখা যায়। তবে এর জন্য বাইরে যাওয়া আবশ্যক নয়, ঘরের মধ্যে থেকেই স্বাভাবিক আলো-বাতাস শরীরে কিছুটা লাগতে দিলেই হবে ইনশাআল্লাহ।]
৩. ছেলেদের জন্য সাইক্লিং, সাঁতার এসব অনেক অপশন রয়েছে। আর বিকেলবেলা পাড়ার ছেলেরা একসাথে ক্রিকেট-ফুটবল নিয়ে মেতে থাকার সুযোগ তো মিস করাই যাবে না!
৪. অসংখ্য ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ রয়েছে যেগুলো বিনা খরচে ঘরে থেকেই করা সম্ভব। দড়ি লাফ, পুশ আপ (বুকডন), স্কোয়াট.. ইত্যাদি।
আরেকদিন সময় করে এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে ইনশাআল্লাহ। তবে আজকে কিছু কথা বলে নিই।
* ব্যায়াম করার মাঝে গ্যাপ দিতে হবে। প্রতিদিন ব্যায়াম করা যাবে না। অর্থাৎ ধরো, তুমি একদিন ব্যায়াম করলে পরের দিন রেস্ট নিলে।
* একদম শুরুর দিনেই খুব বেশি ব্যায়াম করবে না। আস্তে আস্তে বায়্যাম করার সময় বাড়াবে।
* ভরাপেটে খাবার একদম পরপর ব্যায়াম করবে না। আবার একদম খালি পেটেও ব্যায়াম করবে না। হালকা কিছু খেয়ে নিয়ে ব্যায়াম করতে পারো।
* ব্যায়াম করার আগে হালকা স্ট্রেচিং করে নিতে হবে। ব্যায়ামের মাঝে মাঝে ৩০ সেকেন্ড বা ১ মিনিট করে বিশ্রাম নেবে।
* ব্যায়াম করার সময় সতর যেন ঢাকা থাকে সেটা নিশ্চিত করবে। হাফপ্যান্ট পরে ব্যায়াম করবে না। মিউজিক আছে এমন গান শুনতে শুনতে বায়্যাম করবে না।
বুকডন দেবার নিয়ম- https://tinyurl.com/248nadsb
স্ট্রেচিং করার নিয়ম- https://tinyurl.com/4e7rbeae
স্কোয়াট এর নিয়ম- https://tinyurl.com/2p863ey3
প্ল্যাংক এর নিয়ম- https://tinyurl.com/mrrrjyu9
এগুলোর কোনো কোনোটাতে মিউজিক আছে। এজন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। মিউজিক বন্ধ রেখে শুনে নিয়ো।
প্রথমদিনেই নিজের শরীরের ওপর প্রেসার দেবে না। এমন করলে শরীরের ক্ষতি হবে। আস্তে আস্তে সময় বাড়াও। প্রথম দিন ৩টা পুশআপ দাও, তারপর আস্তে আস্তে বাড়াও। স্কোয়াটের ব্যাপারেও তাই করতে পারো। প্ল্যাংকের ক্ষেত্রেও তাই। প্রথমে ২০ সেকেন্ড বা ৩০ সেকেন্ড করো। এরপর আস্তে আস্তে সময় বাড়াও। এগুলো নিয়ে আমরা পরের সংখ্যাগুলোতে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
ব্যায়ামের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমসা হলো, ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে না পারা। কয়েকদিন ব্যায়াম করলাম-শরীরে কোনো পরিবর্তন আসলো না- হতাশ হয়ে বন্ধ করে দিলাম ব্যায়াম করা বা একদিন ব্যায়াম করলাম- তারপর আর ১০ দিন খবর নেই এমন যেন না হয়। ৫ মিনিট করে হলেও রেগুলার ব্যায়াম করতে থাকো ইনশাআল্লাহ। কিছুদিন পরেই ফলাফল দেখতে পারবে ইনশাআল্লাহ!
হতে পারে ইবাদাত!
ফিটনেস ধরে রাখা ও যুদ্ধের কৌশল হিসেবে সাহাবিদের মধ্যে তির নিক্ষেপ, ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা হতো। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ঘটনা তো নিশ্চয়ই জানো- তিনি একবার এক কুস্তিগীরের সাথে চ্যালেঞ্জ করে জিতে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সেই কুস্তিগীর ইসলাম গ্রহণ করে নেয়, আল্লাহু আকবার!
কেউ কি বলতে পারো, সেই কুস্তিগীরের নাম? সঠিক উত্তর খুঁজে নাও এবারের সংখ্যারই কোনো এক পৃষ্ঠায়।
তোমাদের নিয়ত যদি থাকে ফিটনেস ঠিক রাখার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদাতে আরও নিবিষ্ট হওয়া, ন্যায়ের পথে অটল থাকার হিম্মত অর্জন করা.. তা হলে এর পেছনে তোমার প্রচেষ্টাকে আল্লাহ চাইলে তো ইবাদাত হিসেবেও কবুল করতে পারেন, তাই না? ইনশাআল্লাহ!
আরেকটা বিষয়- এক্সারসাইজের জন্য ছোট ছোট গ্রুপ করে বা খেলার মাঠে খেলার ফাঁকে ভাই, বন্ধুদের মধ্যে দ্বীনের দাওয়াতি কাজ করার একটা সুযোগ তৈরি করতে যদি পারো.. যদি একটা সুন্দর দ্বীনি সার্কেল তৈরি করতে পারো- তা হলে তো সেরের ওপর সোয়া সের!
বন্ধুর হাত ধরে আসরের সালাত, খেলেটেলে গায়ে ধুলো মেখে মাগরিবের সময় আবার ওকে টেনে নিয়ে মাসজিদের ওযুখানায় যাওয়া, এরপর একসাথে রবের সামনে মাথা নত করে সিজদায় পড়ে যাওয়ার চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!
অনেক কথা বলে ফেললাম, এবার আমি যাই। আমার ঘুমকাতুরে বন্ধু আলামিন বলছিল আজ একসাথে সাইক্লিংয়ে বের হবে। সাইকেলটা ঘষামাজা করি গিয়ে, আল্লাহ হাফিয!