টগবগে যুবক আপনি। মসৃণ চেহারা। চমৎকার আপনার গড়ন। রাজপুত্রের মতো বললেও কম হয়ে যায়।
দারুল আরকামে গেলেন একদিন আপনি। একটা মিষ্টি ঘ্রাণ পুরো জায়গা জুড়ে ছেয়ে গেল। সবার চোখ আটকে গেল আপনার দিকে। চেহারায় খানিকটা লজ্জা নিয়ে সালাম দিলেন সবাইকে। বসে পড়লেন একদম পেছনটায়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ তখন জান্নাত-জাহান্নামের আলোচনা করছিলেন। জাহান্নামের বর্ণনার সময় নিদারুণ এক ভয় স্পষ্ট হয় উপস্থিত সবার মুখে। আবার যখন জান্নাতের বর্ণনা আসে, সবাই হয়ে উঠে প্রাণবন্ত। আনন্দে খেলা করে উঠে অন্তরগুলো।
একমনে শুনে গেলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সব কথা। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে। জগতের সবচেয়ে পবিত্র মানুষটার সাথে আপনি পাঠ করলেন সেই পবিত্র বাক্য। শাহাদাহ।
শান্ত যুবকের পথচলা শুরু হলো। বুকে স্বপ্ন নিয়ে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রতি ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে গেলেন আপনি। আসতে থাকল একের পর এক বাধা।
সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ মা-ই আপনার বিরুদ্ধে চলে গেল। পরিত্যাগ করল পরিবার। খুলে ফেলা হলো আপনার সেই রাজপুত্রের লিবাস। দামি প্রসাধনী, দামি খাবার-দাবার, বন্ধ করে দেয়া হলো সব।
কুরাইশের মুশরিকরা আপনার পেছনে লেগে গেল। বন্দি করে রাখল আপনাকে। এতকিছুর পরেও যখন একচুলও আপনি নড়েননি সত্য থেকে, তারা আপনাকে আরও দীর্ঘদিন বন্দি রাখল। ভেবেছিল, তাতে হয়তো আপনি থেমে যাবেন। কী বোকা ভাবনা!
একসময় মুক্তি পেলেন আপনি। যেখানে কেটেছিল আপনার শৈশব-কৈশোরের সোনালি দিনগুলো, দ্বীনের খাতিরে ত্যাগ করলেন সেটাও। বন্ধু করে নিলেন জীর্ণ পোশাক, নিদ্রাহীন রাতকে। তবুও আপনি ছিলেন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ﷺ-এর প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। নিজের সব কষ্ট তখন তুচ্ছ ঠেকতো আপনার কাছে।
হিজরত থেকে যখন ফিরে এলেন প্রথমবার, আপনাকে দেখে সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। কী থেকে কী হয়ে গেলেন আপনি...
গায়ে ভেড়ার চামড়া জড়ানো অবস্থায় আপনাকে আসতে দেখে একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ লোকদের আপনাকে দেখিয়ে বললেন,
‘তাকিয়ে দ্যাখো ঐ যুবকের দিকে—যার হৃদয়কে আল্লাহ তাআলা আলোকিত করে দিয়েছেন...।
আল্লাহ ও রাসূলের ভালোবাসা তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে, দ্যাখো।’
শান্ত যুবক থেকে কখন যে আপনি হয়ে উঠলেন এক পরিশ্রমী যুবক, টের পেলো না কেউ। কত মানুষকে ইসলামের ছায়ায় আনলেন। অবস্থা এক সময় এমন দাঁড়াল, ইয়াসরিবের (মদীনার) প্রত্যেকটা ঘরেই একজন না একজন মুসলিম বা মুসলিমাহ ছিল।
বদর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সাদা পতাকা তুলে দেয়া হলো আপনার হাতে। খুব আনন্দের সাথে আপনি তা গ্রহণ করলেন। আপনার হাতে পুরোটা সময় উড়ল সেই পতাকা। আপনিও এগুচ্ছিলেন একদম বীরপুরুষ হয়ে...
উহুদের যুদ্ধ। বদরের মতোই সাদা পতাকা দেয়া হলো আপনার হাতে। হঠাৎ করে পরিস্থিতি হয়ে উঠল ভয়াবহ। মুসলিমদের ওপর আঘাত আসে তীব্রভাবে। এমনকি মুসলিমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে আলাদা হয়ে যায়। সেই কঠিন সময়ে আপনি প্রিয় মানুষটার সঙ্গে ছায়ার মতো ছিলেন। পুরোটা সময় রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর থেকে একচুলও সরেননি আপনি।
হঠাৎ এক মুশরিক ঝাঁপিয়ে পড়ে আপনার ওপর। তরবারির কোপে আপনার একটা হাত কেটে যায়। অন্য হাতে আপনি পতাকা উঁচিয়ে ধরলেন। খানিকপরে আসে আরেকটা আঘাত; দ্বিতীয় হাতটাও কেটে যায়। আপনার দু’বাহু দিয়ে তবুও আপনি উঁচিয়ে ধরলেন পতাকা। ক্ষান্ত হয়নি সেই নাপাক মুশরিক। একটা বর্শা বিধে যায় আপনার বুকে। লুটিয়ে পড়েন আপনি। শামিল হলেন সেরাদের দলে।
যুদ্ধ শেষ হলো। আপনাকে দাফন করার জন্য অভাব পড়ল কাফনের। একটি ছোট্ট কাফন পাওয়া গেল। কিন্তু, ছোট্ট একটি কাফনে তো পুরো শরীর ঢাকা যায় না। মাথা ঢাকলে পা হয় না, পা হলে মাথা...
অথচ কী ছিলেন আপনি!
দ্বীনের ভালোবাসায় খুলে ফেললেন রাজপুত্রের পোশাক। হারিয়ে বসলেন বিলাসিতার সকল উপকরণ। আপনার সুন্দর চেহারা মলিন হলো, কপালে ভাঁজ পড়ল। নরম হাতগুলো আজ ভীষণ খসখসে। রাজকীয় জীবনকে লাথি মেরে ফেলে আসলেন আপনি। বুকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জন্য, দ্বীনের জন্য ভালোবাসাকে সঞ্চয় করে এগিয়ে গেলেন কত পথ। সেই পথে চলতে গিয়ে আপনি এক মুহূর্তের জন্যও অভিযোগ করেননি।
হে মুসআব, আপনাকে আমার খুব ঈর্ষা হয়! খুব! খুউউব! আপনার নাম শুনলে হৃদয়ে একটা ঢেউ খেলে যায়। শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। জান্নাতে আমি আপনার সাথে গল্প করতে চাই। শুনতে চাই আপনার মুখ থেকে দুনিয়ায় আপনার কাটানো সেই দিনগুলোর কথা। কাউসারের পাশে বসে শুনতে চাই আপনার তিলাওয়াত। আমাকে সেই সুযোগ দেবেন, মুসআব?
রদিয়াল্লাহু আনহু।