শহর থেকে বেশ দূরে নিরিবিলি একটা জায়গা। সেখানেই কাব্যদের বাড়ি। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বিশাল এক নদী। অন্যদিকে সবুজ বন। সবমিলিয়ে বাড়িটার আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে। বাড়ির উঠোনও বেশ বড়। উঠোনে দাঁড়িয়ে সায়মা মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছে আর ভাবছে—কাব্য নদীর ধারে একা কী এত খেলে? এত করে কাব্যের আব্বুকে বলি—চলো, শহরে চলে যাই। লোকটা যাবে না। আশ্চর্য একটা লোক! ওর নাকি বাবার ভিটামায়া পড়ে গেছে। বিয়ের পরে আমরা শহরে ছিলাম। আমাদের কোল জুড়ে কাব্য এল। আর আমার অসুখটাও এল। ডাক্তার বলল,আমি আর মা হতে পারব না। আমি বিচলিত হইনি। কাব্যের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা জীবন পার করা যায়। কী সুন্দর মেয়েটা! দুশ্চিন্তায় পড়লাম মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটার বিপদের আশংকায় গ্রামে চলে এলাম। নিরিবিলি থাকব।
*****
কাব্য এসে সায়মাকে জড়িয়ে ধরেছে।
- মা, মা! কী করো?
- কিছু করছি না রে, মা। তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। এই আসার সময় হলো?
কোনো জবাব না দিয়েই কাব্য ঘরে চলে যায়। মেয়েটার কোনো খেলার সাথি নেই। আগে খেলার জন্য শহরে বাচ্চাদের কাছে নিয়ে যাওয়া হতো। ইদানীং তাও হচ্ছে না। লোকটার শুধু কাজ আর কাজ। মেয়েটার দিকে কোনো খেয়ালই নেই, ভাবে সায়মা।
এভাবেই চলছিল দিন। হঠাৎ এক বিকালে বেশ দেরি করে বাসায় ফেরে কাব্য। সায়মা রেগে গিয়ে বলল, একা একা এত কী খেলা করো? সায়মাকে অবাক করে দিয়ে কাব্য বলে, ‘মা আমি তো একা খেলি না। আমার কাছে একটা মেয়ে আসে। নদীর ধারেই ওর বাসা।’
আশ্চর্য হয়ে যায় সায়মা। এ কী! এক মাইলের মধ্যে তো কোনো বাড়ি নেই। তাহলে মেয়েটি আসে কোথা থেকে?
- মেয়েটির নাম কী রে, মা?
- নাম তো জানি না, মা।
সায়মা জানে কাব্য মিথ্যা বলে না। তাহলে কে মেয়েটি? না কি মেয়েটা একা থাকতে থাকতে মানসিক সমস্যায় ভুগছে? বিকালে কামাল এলে তাকে বলতে হবে।
সন্ধ্যে মিললেই কাব্য বই নিয়ে বসে। শব্দ করে পড়ে—
এই ছেলেটা ভ্যাল-ভ্যালেটা
আমাদের বাড়ি যাবি?
এক পয়সার মুড়ি দেব
পেট ভরে খাবি।
এর মধ্যেই বাড়ি ফিরেছে কামাল। সায়মা বলে, ‘এই শোনো! কাব্য আজ কী বলছে, জানো?’
কামাল হাতের ব্যাগটা নামাতে নামাতে বলে, কী বলেছে?
সায়মা খুব আগ্রহ নিয়ে বলতে শুরু করে। সব শুনে কামাল বলে, কয়েক দিন যাক; সব ঠিক হয়ে যাবে।
সায়মা বলে, কাব্যর আব্বু, শোনো...!
কোনো পাত্তা দেয় না কামাল। যেন এ কোনো সমস্যাই না। সায়মা ভাবে, লোকটা এমন হলো কেন? আগে তো বেশ ফুরফুরে ছিল।
পরদিন ভোর না হতেই সন্দেশ বানাতে বসে সায়মা। সন্দেশের কথা বললে, নিশ্চয়ই ওই মেয়েটা বাড়ি আসবে। মেয়েটার নামও কাব্য জানে না। কাব্যটা না ভীষণ বোকা।
কাব্যর হাতে একটা সন্দেশ দিয়ে সায়মা বলে, ‘মা, শোনো। আজ যদি মেয়েটি আসে, ওকে বাসায় নিয়ে আসবে। ওর জন্য সন্দেশ বানিয়েছি।’ কাব্য খুব খুশি হয়ে বলে, ‘ঠিক আছে, মা। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।’
নরম ঘাসে নরম পা ফেলে কাব্য দেয় এক ভো-দৌড়। আবার ফিরেও আসে এক দৌড়ে। এসে বলে, ‘মা, ও আসবে না। বরং সন্দেশের বাটিটা আমাকে দাও, আমি গিয়ে দিয়ে আসি।’
সামনে এগিয়ে যাচ্ছে কাব্য। সন্দেশের বাটি ওর হাতে। গোপনে পিছু নিয়েছে সায়মা। খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে সে। কাব্য যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু একটা শালিক উড়াউড়ি করছে। কাব্য এগুচ্ছে, সায়মাও এগুচ্ছে। কাব্য গিয়ে বসে পড়ল। বাতাসের সাথে কথা বলছে কাব্য? কই, কেউ তো নেই।
সায়মা খুব কাছে যায় কাব্যর।
- কাব্য, এখানে তো কেউ নেই!
চমকে উঠে কাব্য।
‘মা, তুমি এখানে এলে কেন? মা, ও তো চলে যাচ্ছে। ও আর আসবে না, মা।’ এই বলে কান্না শুরু করে দেয়। ভীষণ কান্না। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে সে।
ঘুম থেকে উঠে কাব্য নুপুরের শব্দ শুনতে পায়। চুড়ির টুংটাং শব্দ। খালি গায়ে লাল প্যান্ট পরা ওই মেয়েটি। তার নুপুরের শব্দে ঘর মুখর হয়ে আছে। ভীষণ ভয় করে কাব্যর। চিৎকার করে উঠে সে। দৌড়ে ঘরে ঢুকে সায়মা।
- কাব্য, কী হয়েছে?
- মা, ও তোমাকে খুন করতে চায়। ওর হাতে ছুরি।
আশ্চর্য! কাব্য এসব কী বলছে? ঘরে তো কেউ নেই। আমাদের কাব্য কি পাগল হয়ে গেল! বিচলিত হয় সায়মা। তখনই কামাল ঘরে ঢুকে। দু’হাত দিয়ে কামালকে আকড়ে ধরে সায়মা।
‘কাব্য পাগল হয়ে যাচ্ছে। চলো, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। চলো, আমরা এ গ্রাম ছেড়ে যাই।’
কামাল হাতটা ছড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, সায়মা।’
চিৎকার করে উঠে সায়ম। ‘কিছুই ঠিক হবে না। কিছুই না। তুমি আমাদের ভালোবাসো না, তাই না? তুমি পাথর হয়ে গেছ। পাষন্ড কোথাকার!’
পাষন্ড বলাতে কামাল খুব আহত হয়। ‘সায়মা, তোমার মাথা ঠিক নেই। তোমাকে অনেকবার বলতে চেয়েছিলাম, বলতে পারিনি।’
‘কী বলতে পারোনি?’ কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করে সায়মা।
কামাল নরম হয়ে বলে, ‘তুমি ভুলে গেছ সেদিনটার কথা? শ্রাবণ মাসের তেরো তারিখ। আমরা শহর থেকে ফিরছিলাম। ফিরতে রাত নামলো। জনমানবহীন নদীর বুকে শুধু আমাদের নৌকা। তোমার কোলে কাব্য ঘুমিয়ে পড়েছে। সেদিন ভাগ্য খুবই অপ্রসন্ন ছিল। আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামলো। তুমুল বৃষ্টি। আর ঝড়। আমাদের নৌকা ডুবে গেল। অনেক কষ্টে তোমাকে উদ্ধার করতে পেরেছিলাম। কাব্যকে আর খুঁজে পাইনি। পরদিন কাব্যর লাশ পাওয়া গেল। লাশ দেখামাত্র তুমি অজ্ঞান হয়ে গেলে।’
সায়মা চিৎকার করে উঠল, ‘তুমি চুপ করো। একটা কথাও বলবে না। ঐ তো কাব্য আমার ঘরে। দিব্যি শুয়ে আছে। আজ ওর পুতুলের বিয়ে।’
- এ সবই তোমার কল্পনা, সায়মা। সায়মা বিছানার দিকে তাকাল। সত্যিই কেউ নেই। কাব্যর খেলার পুতুল একা পড়ে আছে। সায়মার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। অস্পষ্ট স্বরে বলেই চলছে, ‘কাব্য! আমার কাব্য!’
[বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে লেখা]