“আমরা কি আসলেই স্বাধীন?”
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নটা মনে হয় আমাদের সবার মনেই উদয় হয়। আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ, যার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অনেক রক্ত ঝরেছে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক পরেও কি আমরা সত্যিকারের মানবিক ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন পাচ্ছি? আমাদের চারপাশে তাকিয়ে দেখো - শোষণ, বঞ্চনা আর অন্যায় যেন আমাদের নিত্যসঙ্গী। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়েই আমাদের পথচলা।
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আমাদের মনে পড়ছে মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীমের কথা। রাহিমাহুল্লাহ। প্রায় চল্লিশ বছর আগে, ১৯৮৬ সালের ১৮-ই জুন ঢাকায় এক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন:
“আমরা বাংলাদেশি নাগরিক। এদেশ সম্পর্কে – (অর্থাৎ) আমাদের নিজেদের সম্পর্কে পর্যালোচনা করা, চিন্তা-ভাবনা করা এবং এর সবকিছু নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা সকলেরই উচিত বলে আমি মনে করি। এই পর্যায়ে সর্বপ্রথম আমি একটি বাক্য উচ্চারণ করতে চাই, আর তা হচ্ছে—বাংলাদেশের মুসলমানরা আজ মজলুম এবং মাহরূম। মজলুম মানে আমরা জুলুমের শিকার—আমাদের ওপর চালানো হচ্ছে অহর্নিশ জুলুম। আর মাহরূম মানে আমরা বঞ্চিত—বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে আমাদের অধিকার থেকে। অর্থাৎ আমাদের যা প্রাপ্য তা আমাদের দেওয়া হচ্ছে না।”
ভাবো তো, এই কথাগুলো তিনি আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে বলেছিলেন। আজকের দিনেও এই কথাগুলো কতটা সত্য, কতটা প্রাসঙ্গিক!
আমরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম, কারণ আমরা জুলুমের শিকার ছিলাম। এটা সত্যি যে, এখানে পার্শ্ববর্তী আধিপত্যবাদী ভারতের কিছু পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু পাকিস্তানের জুলুম যে বাস্তব ছিল, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমাদের পূর্বপুরুষরা চেয়েছিলেন একটি মানবিক ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন। কিন্তু আমরা কি তা পেয়েছি?
এই ভূমির মানুষের বঞ্চনা আর নিপীড়নের ইতিহাস শুধু ১৯৭১ সাল থেকে পড়লে ভুল হবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময়কালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (আজকের বাংলাদেশ) পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়েছিল ইসলামের নামে। কথা ছিল কুরআনের আইন দিয়ে দেশ চলবে, ‘পাকিস্তান কা মাতলাব কিয়া? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ স্লোগানে মুখর হয়েছিল এই জমিনের মুসলিমরা, আশায় বেঁধেছিল বুক। কিন্তু তারা কি প্রকৃত ইসলাম পেয়েছিল? দুর্ভাগ্যজনকভাবে, জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগ পুরো পাকিস্তানের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তারা জনগণের চাওয়াকে উপেক্ষা করে সেক্যুলারিজম আর ব্রিটিশ আইনই চাপিয়ে দিয়েছিল।
আমাদেরকে বারবার বলা হয়, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু সত্যিই কি আমরা স্বাধীন?
মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম বলেছিলেন,
“আমার কাছে স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে—প্রতিটি জাতির তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও ঈমান-আকীদা মোতাবেক জীবনযাপন করার অধিকার পাওয়া। নিজেদের ঈমান-আকীদা অনুযায়ী যদি জনগণ জীবনযাপন করার অধিকার পায়, পায় সুযোগ-সুবিধা, তবে তারা স্বাধীন। আর যদি না থাকে তবে তারা পরাধীন; এক কথায় মজলুম এবং মাহরুম।”
নিপীড়নের ধারা
আমাদের মুক্তির গল্পটা যদি ১৯৭১ সালের পরে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল থেকে শুরু করি, তাহলে দেখতে পাব, স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা দেখা যায়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধান পরিবর্তন করে দেশে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা ছিল একদলীয় শাসন। জনগণের কথা বলার স্বাধীনতা আর রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমান যেন নিজেই একজন জালিম আর স্বৈরাচার হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে মুজিব জাতীয় রক্ষী বাহিনী তৈরি করেন। এই বাহিনীকে দিয়ে বিরোধীদের গুম, খুন আর নির্যাতন করা হয়। যুদ্ধের পর দেশের অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি আর জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া মানুষের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। সরকারের ব্যর্থতা ও লুটপাটের রাজত্বের কারণেই ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল।
এই দুর্ভিক্ষের ওপর অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক জন পিলজার ডেইলি মিররে একটি মর্মস্পর্শী প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “একটি তিন বছরের শিশু এতই শুকনো যে, মনে হলো সে যেন মায়ের পেটে থাকাকালীন অবস্থায় ফিরে গেছে। আমি তার হাতটা ধরলাম। মনে হলো তার চামড়া আমার আঙ্গুলে মোমের মতো লেগে গেছে। এই দুর্ভিক্ষের আরেকটি ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান এই যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৫০ লাখ মহিলা আজ নগ্ন-দেহ। পরিধেয় বস্ত্র বিক্রি করে তারা চাল কিনে খেয়েছে।”
তিনি আরও লিখেন, “সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে এবং গাড়ি আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম-এর লরীর পিছনে পিছনে চলেছে। এই সমিতি ঢাকার রাস্তা থেকে দুর্ভিক্ষের শেষ শিকারটিকে কুড়িয়ে তুলে নেয়। সমিতির ডাইরেক্টর ডাঃ আব্দুল ওয়াহিদ জানালেন, ’স্বাভাবিক সময়ে আমরা কয়েকজন ভিখারীর মৃতদেহ কুড়িয়ে থাকি। কিন্তু এখন মাসে অন্তত ৬০০ লাশ কুড়াচ্ছি—সবই অনাহার জনিত মৃত্যু।”
এই দৃশ্যগুলো ১৯৭১ সালের পরের, যখন আমাদের শেখানো হচ্ছিল যে আমরা মুক্তি পেয়েছি!
এরপর আরও অনেক জালিম এসেছে, আর বাংলার মানুষকে প্রতিনিয়ত বাঁচার জন্য লড়তে হয়েছে।
নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থান (১৯৯০): দীর্ঘ নয় বছরের এরশাদ সরকারের পতন হলেও, পরবর্তী নির্বাচিত সরকারগুলোর সময়েও শোষণ আর নিপীড়নের ধরন বদলেছে বটে, কিন্তু এর মাত্রা খুব একটা কমেনি। এসময় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ আর সহিংসতা বাড়তে থাকে, যা আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে। গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলেও দুর্নীতি যেন আরও পাকাপোক্ত হয়, আর ক্ষমতার অপব্যবহার চলতেই থাকে।
২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার (এক-এগারো): রাজনৈতিক সংঘাতের মুখে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেয়। এ সময় জরুরি অবস্থা জারি করে মানুষের বাকস্বাধীনতা আর চলাচলের স্বাধীনতা সীমিত করা হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চললেও রাজনৈতিক হয়রানি আর নির্বিচার গ্রেফতার বন্ধ হয়নি। বেসামরিক প্রশাসনে সেনাবাহিনীর প্রভাব বেড়ে গিয়েছিল, যা তথাকথিত গণতন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে আবারও প্রশ্ন তুলেছিল।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সরকারের আমল: এই সময় দেশের রাজনীতি কিছুটা শান্ত থাকলেও, মানুষের ওপর অবর্ণনীয় শোষণ-অত্যাচার হয়েছে। পুলিশ, র্যাব মানুষকে নির্বিচারে গুম, খুন, আয়নাঘরে নিয়ে অত্যাচারের মতো কাজ করত প্রায় দৈনিক। সরকারের বিরোধিতা বা সমালোচনা করে কেউ কিছু বললে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু লিখলে তাকে “জঙ্গি/রাজাকার” বলা হতো। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দোহাই দিয়ে তাকে জেলে পাঠানো হতো, করা হতো অত্যাচার। দেশে ধনী-গরিবের ফারাক আরও বেড়ে যায়। বড় বড় নেতা আর ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লুট করে নেয়। মেগা প্রজেক্টগুলোয় (যেমন, পদ্মা সেতু, রূপপুর প্রকল্প) হরির লুটের মতো দুর্নীতি হয়। কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়। বিচার বিভাগ আর দুর্নীতি দমন কমিশন কাজ করে সরকারের বিরোধিতা দমনের হাতিয়ার হিসেবে।
এই সময় আরও কিছু ভয়ানক ঘটনা ঘটে: ২০০৯ সালে ভারতের মদদে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে মেরে ফেলা হয় ৫৭ জন সেনা অফিসারকে। এতে করে সেনাবাহিনীর উপর আওয়ামী সরকারের প্রভাব পাকাপোক্ত হয়। দেশটাকে যেন ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করেছিল সরকার। ভারতের কাছে থেকে আমরা কিছু না পেলেও ভারত পেয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দরের অন্যায্য চুক্তি। প্রতি বছর টন টন আম-ইলিশ উপহার তো ছিলই। বিনিময়ে ভারত সীমান্তে নির্বিচারে আমাদের দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, বাঁধ খুলে দিয়ে প্রতিবছর বানভাসি করেছে হাজার হাজার মানুষকে। ২০১৩ সালের ৫-ই মে শাপলা চত্বর গণহত্যায় রাতের আঁধারে সরকারি বাহিনীগুলোর মাধ্যমে হত্যা করা হয় অসংখ্য নবীপ্রেমী মুসলিমকে। সরকারের বিরোধিতা করলেই ‘জঙ্গি’ বলে কতজনকে যে আয়নাঘরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে, তার হিসাব নেই।
জুলাই অভ্যুত্থান এবং বর্তমান পরিস্থিতি
জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে বটে, কিন্তু আমাদের কাঙ্ক্ষিত মানবিক ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা এখনো এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমরা যেন একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছি।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর আশার সঞ্চার হলেও পূর্ববর্তী দমন-পীড়নের কিছু আলামত ফিরে আসছে। ‘মব’, ‘উগ্রবাদ’, ‘হেযবুতি’, ‘জঙ্গি’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে ইসলামপন্থীদের টার্গেট করা হচ্ছে। কালিমার পতাকা পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীদেরকে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অন্যদিকে, জালিম, ফ্যাসিবাদী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলোকে যেন লাল গালিচা বিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ইসলাম ও মুসলিমদের নিয়ে কটূক্তি করার প্রবণতা বেড়েছে। এমনকি, আওয়ামী জাহিলিয়াতের সময় আওয়ামী-সহযোগী হিসেবে কাজ করা মিডিয়াগুলোকে কোনো প্রকার বিচারের মুখোমুখি না করেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের অখণ্ডতা-বিরোধী এবং আওয়ামী মিডিয়াকে পুরোদমে সচল রাখা হয়েছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় ঘটে যাওয়া গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুষ্ঠু ও দ্রুত বিচার এখনো প্রক্রিয়াধীন। শহীদ ও আহতদের পরিবারগুলো ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত, এবং তাদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি, জুলাই আন্দোলনের একজন শহীদের কন্যা তার শহীদ বাবার কবর জিয়ারত করে ফেরার পথে সম্মানহানীর শিকার হয়ে আত্মহত্যা করার মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনা শহীদ পরিবারের প্রতি রাষ্ট্রের উদাসীনতা এবং কাঙ্ক্ষিত সামাজিক ও মানবিক নিরাপত্তার অভাবকেই তুলে ধরে। আহতদেরও যথাযথ চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। বিচারের মুখ দেখছে না শাপলা গণহত্যা ও আয়নাঘরের ভুক্তভোগীরা। এদিকে সরকারের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। অন্যদিকে হাসিনার আমলের মতো করেই আবারও জঙ্গি নাটক ফাঁদা হচ্ছে, মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে নিরপরাধ নাগরিকদের নামে।
যদিও পূর্ববর্তী সরকারের মতো ব্যাপক দমন-পীড়ন নেই, তবুও ভিন্নমত পোষণকারীদের প্রতি আইনি হয়রানি বা গ্রেফতার দেখা যাচ্ছে। অপরাধীদের বিদেশে চলে যেতে দেওয়া হয়েছে, কোনো সংস্কার হয়নি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলেও, উচ্চ মূল্যস্ফীতি (টাকার মান কমে যাওয়া), বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের জন্য মানসম্মত কর্মসংস্থানের অভাব, আয়ের বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক সংকট এখনো রয়ে গেছে। ভাগ্যের পরিহাস হলো, জুলাই অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিলো ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’ থেকে।
১৯৭১ এর মতো চেষ্টা করা হচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানকেও আমাদের স্বাধীনতা হিসেবে গেলাতে। এই মুক্তি ও স্বাধীনতার গল্প যেন আমাদের ছোটবেলার হাওয়াই মিঠাই।
এই জমিনের মানুষ কেন মজলুম ও মাহরূম?
বাংলাদেশের মানুষ মজলুম ও মাহরূম। তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং তাদের উপর অবিরাম জুলুম চলছে। এর কারণ কেবল কোনো নির্দিষ্ট সরকার বা শাসনব্যবস্থা নয়। এর কারণ ঐতিহাসিক এবং আমাদের পরিচয়গত।
জাতীয় আদর্শের অভাব: আমরা এখনো ঠিক করে উঠতে পারিনি, আমাদের দেশের মানুষের আসল পরিচয় বা আদর্শ কী হবে! কখনো বলা হয় আমরা ‘বাঙালি’, কখনো বলা হয় ‘বাংলাদেশি’। যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা যা চায়, সেটাই চাপিয়ে দেয় আমাদের উপর। কিন্তু সত্যিকারের স্বাধীনতা হলো নিজের ঈমান-আকীদা, সংস্কৃতি, আর মূল্যবোধ অনুযায়ী জীবনযাপন করার অধিকার, যা এখনো আমরা অর্জন করতে পারিনি।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার প্রভাব: প্রায় দু’শ বছরের শাসনামলে ব্রিটিশরা আমাদের মুসলিমদের সংস্কৃতি, আইন-কানুন, বিচার ও শিক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করে নিজেদের তৈরি ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছিল। একসময় আমাদের মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা ছিল বিশ্ব সমাদৃত। কিন্তু ব্রিটিশরা এই ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে নিজেদের বানানো সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়। এর ফলে মুসলিমরা তাদের নিজস্ব শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত হয়েছে, ভুলে গেছে তাদের ইতিহাস ও পরিচয়। এভাবে তারা এদেশীয় কিছু গোলাম তৈরি করেছে, যারা দেখতে ঠিক আমাদের মতো হলেও চিন্তা-ভাবনা, বিশ্বাস সবকিছু ব্রিটিশদের মতো। এই গোলামরাই স্বাধীনতার পরেও ব্রিটিশদের কাঠামোই টিকিয়ে রেখেছে।
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা: ব্রিটিশরা পুঁজিবাদ নামে একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করে, যেখানে দেশের কিছু মানুষের কাছে থাকে অনেক টাকা, আর সাধারণ মানুষ অভাবে-অনটনে কষ্টে থাকে, নিজেদের মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত রয়ে যায়। পাকিস্তান আমলে ‘২২ পরিবার’ এর হাতে ছিল দেশের প্রায় সব টাকা-পয়সা। তাদের মতোই বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পর সম্পদ লুট, ব্যাংক ডাকাতি এবং কালোবাজারি বেড়েছে। সাধারণ মানুষ গরিব থেকে আরও গরিব হয়েছে, দুর্ভিক্ষে অনাহারে মারা গিয়েছে।
মুসলিমদের পরিচয় মুছে ফেলার চক্রান্ত: মুসলিমদের এই ভূমি থেকে মুসলিমদেরই চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছে ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া সেই গোলাম শ্রেণির লোকেরা। তারা কলকাতা থেকে ধার করে আনা হিন্দুয়ানি সংস্কৃতিকে ‘বাঙালি’ সংস্কৃত বলে উৎসাহিত করছে। রমাদান, কুরবানি ইত্যাদির মতো মুসলিম সংস্কৃতির বদলে তারা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে পয়লা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, বসন্ত উৎসব ইত্যাদির মতো বিজাতীয় সংস্কৃতি। মুসলিম-হিন্দু ভিন্ন ভিন্ন দেশ করার লক্ষ্যে বঙ্গভঙ্গ হয়েছিল। এর বিরোধিতা করে রবীন্দ্রনাথ লিখেন তার বিতর্কিত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি। এই গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করাও এই প্রকল্পেরই একটি অংশ ছিল। একই সাথে এটা বাংলাদেশের অখণ্ডতার ওপরেও একটি আঘাত।
সেক্যুলারিজম, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের ব্যর্থতা: সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত সেক্যুলারিজম মূলত ‘ধর্মহীনতা’-ই, যেখানে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে দূরে রাখার সব চেষ্টা করা হচ্ছে। জাতীয়করণের নামে কল-কারখানা লুটপাট ও অচল করে দেওয়া হয়েছে, যা জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের সম্পদ বাড়িয়েছে। এতদিনে পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা যে, গণতন্ত্র একটি ধোঁকাবাজি ও জাহিলি ব্যবস্থা। এটা ব্রিটিশরা এই দেশে প্রবর্তন করেছে এদেশের মানুষকে শোষণ, নিপীড়ন এবং তাদের সম্পদ লুট করার জন্য, তাদেরকে তাদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতি থেকে দূরে রাখার জন্য। এর মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত কল্যাণ হয় না, বরং বলপ্রয়োগ এবং ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রবণতা বাড়ে। নির্বাচনেও জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে না, বরং ক্ষমতার হাতবদল হয় মাত্র। লুটপাটের ক্ষমতা এক পার্টির হাত থেকে আরেক পার্টির হাতে যায়।
রাজনৈতিক নেতা, বেসামরিক বুদ্ধিজীবী, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী এবং সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষমতার তীব্র লোভ বিদ্যমান। সামরিক বাহিনী তাদের মূল দায়িত্ব (দেশের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষা) থেকে বিচ্যুত হয়ে ক্ষমতা দখলে লিপ্ত হয়। এছাড়াও, বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের প্রতি সবসময় নতজানু ভূমিকা পালন করে।
প্রতিটা সময়েই এই চিত্র দেখা গেছে।
তাহলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান কি ব্যর্থ?
জুলাই অভ্যুত্থান একটি বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল বটে। কিন্তু, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এই অঞ্চলের মানুষ আবারও প্রতারিত হয়েছে। এই ভূমির মানুষের সাথে বারবার কেন এমন হয়? এই প্রশ্নটি আমাদের মনে ঘুরপাক খায়। এত ত্যাগ, এত রক্তক্ষয়, তারপরও কেন এই জাতি বারবার বঞ্চিত হয়? কিন্তু, যুগে যুগে যখনই ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে, এই জাতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ফরায়েজী আন্দোলন, তিতুমীরের বাশেরকেল্লা বিদ্রোহ, ৫-ই মে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান—এই সবই এই জাতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রমাণ। আল্লাহ এই জাতিকে শক্তি দিয়েছেন, সংগ্রামী চেতনা দিয়েছেন।
আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানটাও চিন্তা করুন—চারপাশে আগ্রাসী ভারত, আর মাঝখানে বাংলাদেশ। এত প্রতিকূলতার মাঝেও এই ভূমিটাকে আল্লাহ কেন টিকিয়ে রেখেছেন এত দিন ধরে? এর পেছনে নিশ্চয়ই আল্লাহর কোনো উদ্দেশ্য কাজ করছে। সম্ভবত, এই জাতিকে আল্লাহ বিশেষ কোনো কাজের জন্য প্রস্তুত করছেন।
এই ভূমির মানুষের মুক্তি ঘটবে একমাত্র ইসলামের মাধ্যমে। কেবল ইসলামের মাধ্যমেই এই জমিনের মানুষের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা এবং মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত হবে। এর জন্য প্রয়োজন বৈপ্লবিক পরিবর্তন। পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙে নতুন করে গঠন করা। ইসলামের ভিত্তিতে এই পরিবর্তনে আমাদের সামগ্রিক এবং সম্মিলিত করণীয় রয়েছে:
- সমাজের প্রতিটি স্তরে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও তাওহীদের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া;
- সুদবিহীন অর্থনীতি, যাকাতভিত্তিক সমাজ এবং হালাল উপার্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার প্রচেষ্টা;
- ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য ইসলামী শরীয়াহভিত্তিক বিচার ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়া;
- ইসলামী মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা;
- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ইসলামী বিধান ও নিদর্শন নিয়ে যেকোনো কটূক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা;
- পার্শ্ববর্তী সম্প্রসারণবাদী ভারতীয় শক্তির বিরুদ্ধে সবসময় সজাগ থাকা;
- মুসলিম পরিচিতি ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা;
- জনগণের মধ্যে সঠিক ইসলামী রাজনৈতিক জ্ঞান ও সচেতনতা তৈরি করা।
এই জাতির দায়িত্ব তোমার কাঁধে। এই পরিবর্তন তুমিই নিয়ে আসবে, তোমাকেই চেষ্টা করতে হবে, সচেষ্ট হতে হবে।
যে জাতি নিজের অবস্থা পরিবর্তনে সচেষ্ট হয় না, সে জাতির অবস্থা আল্লাহও পরিবর্তন করেন না।