আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল অয়নের। ‘ধুর! আয়নাই দেখব না আর..’

কিন্তু আয়না না দেখলেই যদি সমস্যা সমাধান হতো তবে তো ভালোই হতো। তা তো আর হচ্ছে না। স্কুলের মিজান, বিল্টু, মারুফ.. ওদের কে থামাবে? অয়নকে সামনে পেলেই তো টিটকারি শুরু হয়ে যায়। যেন ও একটা কৌতুকের বস্তু!

জীবনে কখনো ব্রণের সমস্যায় পড়েননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আদৌ আছে কি না কে জানে! অয়ন যখন আমাকে জানাল ওর সমস্যাটা, তখন ওকে বলেছিলাম একদিন সময় করে ওর সব কথার উত্তর দেব। আজ ওকে নিয়ে বসেছি। তোমরা চলে যাবে কেন? তোমরাও বসো, গোল হয়ে বসো কিন্তু সবাই।

চলো, বয়ঃসন্ধিকালের এই স্বভাবিক কিন্তু একই সাথে বিরক্তিকর ব্যপারটাকে একটু জানার চেষ্টা করি।

আচ্ছা ভাইয়া, এটা কেন হয়?

-বয়ঃসন্ধিকাল হলো জীবনের একটা স্পেশাল সময়। শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পণের এই রিহার্সেল মোমেন্টটাতে তোমার শরীর নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করে। নতুন করে নানা রকম হরমোনাল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শুরু হয় তোমার এই দেহজমিনে।

‘অ্যান্ড্রোজেন’ ঠিক এমনই একটা হরমোন, যা এই সময়ে খুব বেশি বেশি ক্ষরণ হতে থাকে। এবং এই হরমোন বাবাজির কারণেই মুখ, ঘাড়, বুক বা পিঠের ত্বকে থাকা তৈলগ্রন্থিগুলো ফুলে-ফেঁপে বড় হয়ে উঠতে থাকে আর সেগুলো আরও বেশি বেশি তেল (সেরাম) নিঃসরণ করতে থাকে। ফলাফল- ব্রণ।

একই সাথে বলে রাখি ‘জীবাণু’ সংক্রমণের ফলেও কিন্তু ব্রণ হতে পারে। এবং সেটারও চিকিৎসা রয়েছে। তবে আমাদের আজকের আড্ডার বিষয় কেবল বয়ঃসন্ধিকালীন ব্রণ, ঠিক আছে?

বুঝলাম ভাইয়া। কিন্তু, বয়সন্ধিকালেও তো অনেকের ব্রণ উঠে, অনেকের আবার উঠে না। অনেকের বেশি উঠে, অনেকের কম- এর কারণটা কী?

-ঠিক বলেছ। আসলে সবার ত্বকের গঠনবৈশিষ্ট্য কিন্তু এক না। আবার হরমোনের তারতম্যের কথা বললাম যে- সেটাও সবার সমান হয় না। সেই সাথে দেখা যায় কেউ টুকটাক ত্বকের যত্ন নিচ্ছে, কেউবা আবার একেবারেই উদাসীন। পার্থক্যটা আসলে তখনই দেখা যায়।

আচ্ছা! আচ্ছা! তো এবার আসল কথা বলেন ভাইয়া, আমাদের যাদের এই সমস্যা আমরা করব টা কী?

- বলছি, শোনো...

  • প্রথম কথা হলো, বয়সটাকে বিবেচনা করে বিষয়টাকে সহজভাবে নাও, অহেতুক চিন্তা করবে না। কারণ- দুশ্চিন্তা, স্ট্রেস এগুলো শরীরের হরমোনাল কার্যক্রমকে আরও প্রভাবিত করে, যা পরোক্ষভাবে ব্রণ তৈরির জন্য সহায়ক।
  • ঘুম পর্যাপ্ত হচ্ছে তো? কোনো কারণে যদি তোমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে (রাত জেগে পড়াশোনা বা এমনি অকারণে রাত জাগা) তো সেটা সমাধানের চেষ্টা করো। কারণ, নিদ্রাহীনতা এই সমস্যাকে আরও বাড়াবে বই কমাবে না।
  • প্রচুর পানি পান করো।
  • রোদ থেকে বাঁচার চেষ্টা করো, প্রয়োজনে ক্যাপ বা ছাতা ব্যবহার করবে।
  • অতিরিক্ত এসিড বা ক্ষারযুক্ত সাবানের বদলে Dove জাতীয় কোমল সাবান ব্যবহার করবে। সাবানের পিএইচ সীমা ৫.৫ এর কাছাকাছি হলে বেশি ভালো হয়।
  • ভিটামিন-এ/সি/ই যুক্ত খাবার বিশেষ করে রঙিন ফলমূল-শাকসবজি বেশি পরিমাণে খাবে। জিংক সমৃদ্ধ খাবারও (মাংস, ডিম, বাদাম) ত্বকের জন্য বেশ ভালো।
  • আক্রান্ত স্থানগুলোতে অ্যালোভেরা জেল/মধু লাগিয়ে ইনশাআল্লাহ উপকার পেতে পারো। অ্যালোভেরায় ময়েশ্চারাইজিং উপাদান রয়েছে, আর মধুতে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। (যেভাবে ব্যবহার করবে: ২ টেবিল চামচ মধুর সাথে ১ টেবিল চামচ অ্যালোভেরা মিশিয়ে ব্রণের স্থানে লাগাও। দশ মিনিট পর কুসুম গরম পানিতে ধুয়ে নাও।)
  • এছাড়াও বাজারে ভালো ব্র্যান্ডের কিছু অ্যালোভেরা জেল/ক্রিম/ফেসওয়াশও রয়েছে। নির্দেশিকা অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারো।
  • আরেকটা কাজের জিনিস হলো- নিম পাতা। নিম পাতা বেটে, পুরা মুখে লাগিয়ে রাখো ১০/১৫ মিনিট। সপ্তাহে ১/২ বার।
  • সবশেষে প্রয়োজন মনে করলে তুমি ভালো কোনো চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে পারো।

যা যা করবে না-

  • খোঁটাখুঁটি একদমই করবে না। এতে করে তুমি কিন্তু নিজেই ত্বকের মধ্যে আরও জীবাণু প্রবেশের রাস্তা তৈরি করে দিচ্ছ!
  • বেশি সচেতন হয়ে বারবার মুখ ধোয়ার দরকার নেই। বরং দিনে পাঁচবার ওযু করাই যথেষ্ট। অতিরিক্ত মুখ ধোয়া/বেশি বেশি ঘষা-মাজার ফলে ত্বক রুক্ষ-শুষ্ক হয়ে শেষমেশ হিতে বিপরীত হয়।

বাহ! অনেক কিছু জানলাম। আচ্ছা, ডাক্তারের কথা বলছিলেন। ডাক্তার দেখাব কখন?

- বেশিরভাগের ক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে ব্রণ এমনিতেই ভালো হয়ে গেলেও অনেকের জন্য ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন হতে পারে।

ওপরের পরামর্শগুলো যথাযথ অনুসরণের পরও অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের নিকট যেতে হবে। আরেকটা ব্যপার বলে রাখা দরকার যে, অনেকক্ষেত্রেই স্কিনের ট্রিটমেন্ট আসলে একটু সময়সাপেক্ষ এবং একই সাথে ব্যয়সাপেক্ষ তো বটেই। অনেকের তো বছর ধরে ট্রিটমেন্ট চলে। অতএব ধৈর্য ধরে বিশেষজ্ঞের অধীনে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।

আচ্ছা, ফেসওয়াশের কোনো কার্যকারিতা কি আসলে আছে? কোনটা ব্যবহার করব?

-তা তো কিছুটা আছেই ভাই। তবে ফেসওয়াশটি হতে হবে ভালো ব্র্যান্ডের এবং তোমার ত্বকের জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ।

শুষ্ক ত্বকের জন্য:

পেট্রোলিয়াম, মিনারেল অয়েল, ল্যানোলিন যুক্ত ফেসওয়াশ।

তৈলাক্ত ত্বকের জন্য:

অ্যলোভেরা, টি ট্রি (Tea tree) অয়েল, স্যালিসাইলিক এসিডযুক্ত ফেসওয়াশ।

যদি কোনোটা ত্বকের জন্য ইরিটেটিং মনে করো, তখন সেটা আর ব্যবহার না করাই শ্রেয়।

মূলত ব্যবহারের পর তুমি নিজেই বুঝতে পারবে যে- এটা তোমার ত্বকের জন্যে প্রযোজ্য কি না।

ইয়ে মানে, সবই তো ক্লিয়ার হলো, ভাইয়া। তবে, আরও একটা প্রশ্ন ছিল, কীভাবে যে বলি!

আচ্ছা! মাস্টারবেশনের সাথে ব্রণের সম্পর্ক কতটুকু? যে যত বেশি মাস্টারবেট করে তার ব্রণ না কি তত বেশি হয়?

-আমি নিজে থেকেই এ ব্যপারটা বলতাম তোমাদের। ভালো করে শোনো, চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে এ দু’য়ের মধ্যে আসলে সরাসরি কোনো সম্পর্কই নাই।

মূলত যেই সময়টাতে (বয়ঃসন্ধিকালে) স্বাভাবিকভাবেই কারও ব্রণ উঠার কথা, ঐ সময়টাতেই বেশিরভাগের হস্তমৈথুনের বদঅভ্যেস গড়ে ওঠে বলে দু’য়ে দু’য়ে চার মিলিয়ে ধরেই নেয়া হয় কারণ বোধহয় ঐটাই!

না ভাই, হস্তমৈথুনের সাথে আসলে এর কোনো সম্পর্ক নেই আসলে। পুরোটাই মিথ।

কী! খুশি হয়ে গেলে? ভাবছ- আরিব্বাহ! তবে তো এবার হস্তমৈথুনের বৈধতা চলে আসলো, না কি?

নাহ! মোটেও না। বরং ব্রণের চেয়েও আরও বড় বড় ক্ষতির কারণ এই পর্ন-মাস্টারবেশন দুষ্টজাল। ব্রণ তো ছোট্ট পুঁচকে, বাকিরা বিশালদেহী দানব। অতএব জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে এসো। ভেতরটাকে নোংরা রেখে পুরো ফোকাসটা কেবল বাইরের আবরণে দিলে চলবে না কি বলো?

চলো যুদ্ধে নামি। ভেতরটাকে মুছে সাফ করার যুদ্ধে

হৃদয় গহীনের আবর্জনা দূর হয়ে সেখানে গড়ে তুলি সুবাসিত ফুলের বাগান।

অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের সীমাহীন দীপ্তি আভা ছড়িয়ে পড়ুক আমাদের প্রতিটি চোখে মুখে!

ইনশাআল্লাহ!