‘আরে ব্যাটা, দিনই তো শুরু হয় রাত ১২ টার পর। বন্ধুদের সাথে কার্ড খেলবি, জানপাখির সাথে “দুষ্টু মিষ্টি” চ্যাট করবি, মুভি দেখবি, সিরিজ দেখবি, কখনো কখনো নিয়ন আলোর নিচে বসে গান গাইবি, বিড়ি হাতে, চাদর গায়ে ক্যাম্পাসে এলোমেলো ঘুরে বেড়াবি (নিজেকে মহান কবি, সাহিত্যিক বা বুদ্ধিজীবী মনে করবি), চে গুয়েভরার ক্যাপ পরে গাঞ্জার কল্কিতে সুখটান দিয়ে একটু বিপ্লব বিপ্লব যিকির করবি… এটাই না হলো লাইফ। এগুলো না করে কেন সন্ধ্যাবেলা ঘুমাইয়া যাস। ব্যাটা ক্ষ্যাত!’

মোটামুটি এই ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে বাংলাদেশের সেক্যুলার, কালচাড়াল জমিদাররা। রাতে জেগে থাকা, সকালে বা ক্লাসে বসে ঘুমানো স্মার্টনে, আধুনিক হবার পূর্বশর্ত। ক্ষ্যাত পোলাপানই কেবল রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে।

এর বাহিরে অনেকে পড়াশোনার জন্যেও রাত জেগে থাকে। দিনের বেলায় সময় পাওয়া যায় না, রাত জেগে পড়াশোনা ছাড়া উপায় নেই।

কারণ যাই হোক, রাতে জেগে থাকা একটা মহামারি আকার ধারণ করেছে। এর কারণে চরমভাবে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয়। বয়স কম, শরীরে শক্তি থাকার কারণে বিষয়গুলো বোঝা না গেলেও, রাত জাগার কারণে যে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয়, তা বোঝা যায় বয়স একটু বাড়লেই। কিন্তু ততদিনে যা হবার তা হয়েই যায়। পাশাপাশি রাত যত বাড়তে থাকে পোলাপানের কুকর্ম তত বাড়তে থাকে। গভীর রাতে এসে শয়তান মনে হয় একযোগে লাড়াচাড়া দেওয়া শুরু করে। এই বয়সটার সবচেয়ে ভয়াবহ কুকর্মগুলো হয়ে থাকে রাতের গভীরেই।

তাই রাত জাগার অভ্যাস বাদ দিতেই হবে।

আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তিনিই সবচেয়ে ভালো জানেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন  তোমরা রাতে ঘুমাও আর দিনে কাজ করো।

‘আল্লাহ তোমাদের জন্য রাত বানিয়েছেন; যাতে তোমরা তাতে বিশ্রাম করতে পারো এবং দিনকে করেছেন আলোকোজ্জ্বল। নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি বড়ই অনুগ্রহশীল। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।’ [1]

যুক্তরাজ্যের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. পিরেঞ্জ লেভি বলেন, রাত জাগার বদভ্যাস যারা গড়ে তুলেছে, তাদের ৯০ শতাংশই মানসিক রোগের শিকার। ৩০ শতাংশে থাকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি। এ ছাড়া স্নায়বিক সমস্যা থেকে শুরু করে অন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়।[2]

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, রাতে দেরী করে ঘুমালে অনেক ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি দিনের ঘুম দ্বারা রাতের ঘুম কাভার করা যায় না। আর ঘুম কম হবার কারণে শারীরিকভাবে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। পৃথিবীজুড়ে ১৫৩টি গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কম ঘুমের কারণে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগের সম্পর্ক আছে। প্রায় ৫০ লাখ মানুষের ওপর এসব গবেষণা চালানো হয়েছে। [3]

এখন তুমি যদি এসব ক্ষতি মেনে নিয়ে রাতে জেগে থেকে চিইল করতে চাও করো। সিদ্ধান্ত তোমার।

রাতে দ্রুত ঘুমানো ও সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠার গুরুত্ব :

এটা যে আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তা বোধহয় বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের জীবনটাই একদম বদলে যাবে যদি আমরা দ্রুত ঘুম থেকে উঠে জেগে থাকতে পারি।

রাসূল (সা.) কোনো যুদ্ধ অভিযানে বাহিনী পাঠানোর সময় দিনের শুরুতে পাঠাতেন। বর্ণনাকারী বলেন, সখর রাদিয়াল্লাহু আনহু- একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি তার ব্যবসায়িক কার্যক্রমও ভোরবেলা শুরু করতেন। এতে তার ব্যবসায় অনেক উন্নতি হয় এবং তিনি বিপুল প্রাচুর্য লাভ করেন।[4]

এছাড়াও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, ভোরে বান্দার রিযিক বণ্টন করা হয়। যারা ওই সময়টাতে ঘুমিয়ে থাকে, তারা সার্বিক সাফল্য থেকে বঞ্চিত হয়। রিযিকে বরকতের ছোঁয়া পায় না। রাসূল (সা.) বলেন, ‘সকালবেলায় রিযিকের অন্বেষণ করো! কারণ, সকালবেলা বরকতপূর্ণ ও সফলতা অর্জনের জন্য উপযুক্ত সময়।’[5]

তো, এতকিছু জানার পরে রাত জেগে থাকার কারণে বরকতময় সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়? কোনো বুদ্ধিমান, স্মার্ট ছেলেমেয়ের কাজ হয়?

সকালে ঘুম থেকে উঠার আরও কিছু উপকারিতা হলো—

ক)  রাত জেগে পড়ার চাইতে যারা সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়াশোনা করে, তাদের ফলাফল তুলনামুলক ভালো হয়। আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণা করে এটি প্রমাণিত হয়েছে।

খ) শক্তি বৃদ্ধি পায়।

গ) কাজের জন্য বেশি সময় পাওয়া যায়, প্রোডাক্টিভিটিও বাড়ে। অন্যরা জেগে উঠার আগেই তাদের চেয়ে ২/৩ ঘণ্টা এগিয়ে থাকবে তুমি। দেরী করে ঘুম থেকে উঠলে অনেক সময়ই মাথা ঝিমঝিম করে, মাথা ব্যাথা করে। কাজে ঠিকমতো মনোযোগ দেওয়া যায় না। বিছানা থেকে উঠেই তড়িঘড়ি করে খেয়ে-না-খেয়ে ক্লাসে দৌড়। একটা অস্থিরতা নিয়ে দিনটা শুরু হয়। নাস্তা না করার ফলে শরীরের যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি প্রোডাক্টিভিটিও কমে যায়। ধীরে-সুস্থে সকালের নাস্তা সারাদিন জুড়ে তোমার মাথাকে রাখবে ঠান্ডা। কাজের প্রতি মনোযোগী। তোমার প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে অনেক। জীবনটা হবে গোছানো।

ঘ) চেহারা সুন্দর হয়।

ঙ) জীবন হয় সুখের।

যুক্তরাজ্যের সুবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রোনোলজি বিভাগের অধ্যাপক জন রিচার্ডসন বলেন, ‘আমরা দেখেছি, যারা দেরী করে ঘুম থেকে উঠে, তারা নানা ধরনের মানসিক ও শারীরিক জটিলতায় ভোগে। তাদের গড় আয়ু নিয়মিত সকালে উঠা মানুষের চেয়ে সাড়ে ছয় বছর কম।’

আবার অন্যদিকে অন্য গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের ভোরে ঘুম ভাঙে, তারা বেশি সুখী হন। এই সুখ স্বল্পমেয়াদি নয়, বরং সারাটা জীবন ধরেই সুখ ছুঁয়ে যায় তাদের।

রাতে কীভাবে দ্রুত ঘুমাব?

সারাদিন শুয়ে বসে থাকা যাবে না। খেলাধুলা বা ব্যায়াম করতে হবে। বাহিরে ঘুরাফেরা করতে হবে। তাহলে  শরীর ক্লান্ত থাকবে, রাতে তাড়াতাড়ি ঘুম চলে আসবে।

রাতে তুমি যে সময় ঘুমাতে যাচ্ছ, তার মোটামুটি ১ ঘণ্টা আগে থেকে ফোন ব্যবহার করা বন্ধ করে দাও। ফোন হাতে থাকলে আসলে দ্রুত ঘুমানো সম্ভব হয় না। কীভাবে সময় চলে যায় বুঝাই যায় না। এছাড়া স্ক্রিন থেকে যে রশ্মি বের হয়, তা চোখের ঘুম তাড়িয়ে দেয় বুলেটের বেগে।

রাতে ঘুমানোর আগে ওযু করে নাও। পারলে দু’রাকাত সালাত পড়ো। বিছানাটা ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করে নাও। মশার অত্যাচার থাকলে মশারি টানিয়ে নাও। মশারি টানানোর আলসেমি রাতের ঘুম হারাম করে দেবার জন্য যথেষ্ট। ‘হিসনুল মুসলিম’ বই বা এপস[6] থেকে ঘুমানোর দুআগুলো পড়ে নাও।

শুয়ে থাকার পরেও ঘুম না ধরলে লেকচার শুনতে পারো। বই পড়তে পারো। পরকাল নিয়ে, নবি-রাসূল, সাহাবিদের জীবনী যেগুলো অন্তর নরম করে বা অন্য কোনো বিষয়ে। ঘুমানোর সময় কুরআন তিলাওয়াত শুনতে পারো। তবে ফোন একটু দূরে রেখে শুনতে হবে। কাছে রাখলে আবার একটু ফেসবুকে বা টিকটিকে যেতে ইচ্ছা করবে। এরপরও ঘুম না ধরলে উঠে ক্লাসের পড়া পড়তে থাকবে। ঘুম ধরবে না, ওর বাপ ধরবে।

তোমার রাত জাগার অভ্যেস থাকলে প্রথম প্রথম রাতে দ্রুত ঘুমানোর ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। তবে চেষ্টা করতে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।

হলে বা মেসে থাকলে রাতে দ্রুত ঘুমানো যায় না এমন দাবি অনেকেই করে। এটা আসলে একটা পর্যায় পর্যন্ত সত্য। তবে তোমার যদি ইচ্ছা থাকে, তাহলে ঠিকই উপায় বের করে ফেলতে পারবে।

ক) প্রথমত, রুমমেটদের বোঝাতে পারো দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া এবং সকাল সকাল জেগে উঠার উপকারিতা। এবং তুমি দ্রুত ঘুমাতে চাও, ধীরস্থিরভাবে জামায়াতের সাথে ফজরের সালাত পড়তে চাও। একদিন বোঝালে হয়তো কাজ হবে না, তবে ক্রমাগতভাবে বোঝাতে থাকলে ইনশাআল্লাহ কাজ হবে। কেউ কেউ দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে চাইবে। আগে একেবারেই দ্রুত ঘুমানোর পরিবেশ না থাকলে এখন কিছুটা হবে। হয়তো মেইন লাইট বন্ধ করে দিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বালাবে। সাউন্ড বক্সে গান বাজাবে না। অন্তত তুমি দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লে কেউ তোমাকে ঘাঁটাবে না। 

খ) সুযোগ থাকলে রুমমেটদের নিয়ে একেবারে কাকডাকা ভোরে ক্রিকেট/ফুটবল ইত্যাদি খেলার প্ল্যান করো। দুই একদিন ভোরে ওদের জাগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে ওরা মজা পেয়ে যাবে। তখন রেগুলার তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে সকাল সকাল উঠে খেলতে যেতে চাইবে। ভোরের পাখি টাইপ ছোটখাটো কমিউনিটি বানিয়ে ফেলতে পারো। যারা রাতে দ্রুত ঘুমাবে, ফজর মসজিদে পড়বে। এরপর কিছুক্ষণ একসাথে ব্যায়াম করবে, খেলবে, মজা করবে।  

গ) রুমমেটরা লাইট বন্ধ না করলে তোমার মশারির উপর গামছা, লুংগি ইত্যাদি দিয়ে আড়াল করে নিতে পারো। এতে আলো কমে আসে। ঘুমানোর পরিবেশ তৈরি হয়। এছাড়া বাজারে আই মাস্ক পাওয়া যায়। খুব বেশি দাম পড়ে না। এগুলো কিনে নিতে পারো। চাইলে নিজে বানিয়েও নিতে পারো। এটা চোখে দিলে আর আলো লাগবে না চোখে ইনশাআল্লাহ।

ওযু করে, ঘুমানোর দুআগুলো পড়ে শুয়ে পড়ো। আল্লাহর কাছে দুআ করো। আল্লাহ তোমার জন্য সহজ করে দেবেন। শত হট্টগোল, আলোর মাঝেও তোমার চোখে নামবে শান্তি আর পরিতৃপ্তির ঘুম।[7]

আজ এ পর্যন্তই। ইনশাআল্লাহ, পরবর্তী পর্বে আবার দেখা হবে 'ফজরে কীভাবে ঘুম থেকে উঠব? ঘুম থেকে উঠার পর জেগে থাকতে অনেক কষ্ট হয়, আবার ঘুমিয়ে পড়ি… কী করব?' ইত্যাদি বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর নিয়ে।

[ষোলো ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত]


[1] (সূরা গাফির : ৬১)

[2] https://tinyurl.com/latesleepingharm

[3] https://www.bbc.com/bengali/news-56459432

[4] আবু দাউদ : ২৬০৬

[5] মাজমাউজ জাওয়ায়েদ : ৬২২০

[6] লিংক- https://greentechapps.com/apps/hisnulbn

[7] আমাদের একজন বন্ধু ছিল। রাত ১০ টায় ঘুমিয়ে পড়ত। ওর রুমমেটরা ওকে জ্বালানোর জন্য সাউন্ডবক্সে গান বাজাতো উচ্চস্বরে। এরপরেও সে বিছানায় যাবার একটু পরেই ঘুমিয়ে যেত। ওকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- কেমন করে পারিস এমন হইচই এর মাঝে ঘুমাতে? আল্লাহর কাছে চাইলে আল্লাহ্‌ ঠিকই ব্যবস্থা করে দেন- এই জবাব দিয়েছিল সে।