ফ্রান্স, ১৪ ই জুলাই ১৫১৮।
স্ত্রেসবার্গের রাস্তায় একজন নারী অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাচতে শুরু করলেন। সরু-কাঁচা একটি রাস্তায় উগ্রভাবে নাচতে লাগলেন ত্রোফিয়া। নাচতে নাচতে শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন, তবু নাচা থামছে না তার। আশেপাশের মানুষ অবাক হয়ে দেখছে ত্রোফিয়াকে। মানুষ ভাবছে, কোথাও তো কোনো গান বাজছে না, আর না কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে। তাহলে ত্রোফিয়া কেন নাচছে? একদিন-দুদিন, ত্রোফিয়ার নাচে সঙ্গী হচ্ছে একের পর এক মানুষ। এ মানুষগুলোও অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাচছে, কারও নাচের মাঝে কোনো নির্দিষ্ট মুদ্রা নেই, কেউ কারও সাথে তাল মিলিয়েও নাচছে না। ত্রোফিয়া ও তার সঙ্গীদের নাচ চলছে উন্মাদের মতো। একজন-দুজন করে উন্মত্ত নাচ নাচছে প্রায় ৩৬ জন মানুষ। এক সপ্তাহ পর ত্রোফিয়ার নাচ থেমে যায়, শরীর ভেঙে আসে, ভেতর ও বাহিরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংকুচিত হয়ে পড়ে। ত্রোফিয়ার সঙ্গীদের অনেকে মারা যেতে থাকে। একটানা নাচের কারণে শরীরের বিভিন্ন অংশ বিকল হয়ে পড়ে। হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকে অসংখ্য মানুষ।১
কিন্তু ততদিনে পানি বহুদূর গড়িয়ে গিয়েছে। শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এই নাচের কথা। কেউই জানেনা কী কারণে মানুষ এমন আচরণ করছে। আগস্ট মাসের মধ্যে মানুষের সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে, ছড়িয়ে পড়ছে দাবানলের
মতো। স্ত্রেসবার্গ সরকার একটি কাউন্সিল গঠন করল। ডাক্তারদের হাতে দিলো বিষয়টা দেখবার জন্য। কিন্তু ডাক্তাররাও এর কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না। কিছু করতে না পেরে বলে দিলেন, “নিজেদের ইচ্ছেমতোই নাচছে!”২ এমনকি মানুষের নাচার জন্য নাচের হলগুলোকে শক্তপোক্তভাবে মেরামত করা হয়েছিল, শিল্পীরা বাদ্যযন্ত্র আরও সাড়ম্বরে বাজাতো। কিন্তু এতে হীতে বিপরীত হলো। সরকার জনসম্মুখে নাচ নিষিদ্ধ করে দিলো, এমনকি বাদ্যযন্ত্র ও গানকেও নিষিদ্ধ করা হলো।৩
পনেরশ শতাব্দীতে ইতালিতেও কাছাকাছি একটি ঘটনা পাওয়া যায়। একজন নারীকে একটা ট্যারানটুলা কামড় দেয়। এরপর সে এভাবে নাচতে শুরু করে।৪ মধ্যযুগের ইউরোপে এই নাচকে মনে করা হয়েছিল “শয়তানের প্রভাব” বা “ডিমোনিক পোজেজন”।৫ কেউ কেউ বলত, পাপ থেকে মুক্তি পাবার জন্য মানুষ এভাবে নাচছে।৬ তবে প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি শয়তানের প্রভাবে বা পাপমোচনের জন্য বদ্ধ উন্মাদের মতো মানুষ নেচেছিলো? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি না।
আধুনিক গবেষকরা মানুষের এই নাচকে নাম দিয়েছেন “ডান্সিং প্লেগ অফ মিডিভালস”। তারা এই নাচের বিপরীতে কয়েকটি থিওরি সামনে এনেছেন। এক, অনেকে বলেন এটা খাদ্য বিষক্রিয়া বা “ফুড পয়জনিং” এর কারণে হয়েছিল। প্রথম থিওরি অনুযায়ী সেসময় রুটি বানানোর জন্য এক ধরনের ছত্রাক ব্যবহার করা হতো, এর নাম ছিল এরগট। ফানজাই শ্রেণিভুক্ত একটি জীব। এই এরগটে থাকে “এরগট্যামিন” নামক সাইকো-অ্যাক্টিভ পদার্থ, যা মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটাতে সক্ষম। তবে বিখ্যাত মেডিকেল ম্যাগাজিন “দ্য ল্যানচেট” এই থিওরিটিকে অযৌক্তিক দাবি করে। কারণ এরগটের প্রভাব ১ দিনের বেশি থাকে না, যেখানে ডান্সিং প্লেগে আক্রান্ত মানুষ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস নাচত। এছাড়াও যদি এরগটের কারণেই মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে থাকে, তাহলে তাদের বিকৃতির একটা সাধারণ বা কমন প্যাটার্ন থাকবার কথা, যেটা সেসময়ের মানুষের মধ্যে দেখা যায় না।
দ্বিতীয় থিওরিটা হলো স্ট্রেসের কারণে হিস্টেরিয়া। একে বলা হয় মাস সাইকোজেনিক ইলনেস [Mass Psychogenic Illness, MPI] - হঠাৎ করে অনেক মানুষের একত্রে উদ্ভট অঙ্গভঙ্গি করা। মানসিক চাপের কারণে এ ধরনের অসুস্থতা দেখা দিতে পারে।
আরেকটি থিওরি অনুসন্ধান করা হয় ইতালির ঘটনা থেকে। একে বলা হয় “ট্যারান্টিজম”- যেখানে বিষধর মাকড়সা কামড়ের পর উন্মত্ত নাচ নাচার রেকর্ড পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, স্কোর্পিও বা ট্যারান্টুলা কামড়ের পর বিষের প্রভাবে এমন আচরণ করে থাকতে পারে মানুষ।৭
ডান্সিং প্লেগের কারণ আজও অজানা। শোনা যায় এই ভয়ঙ্কর রকমের অদ্ভুত রোগীদের [ডান্সারদের] অন্যদের থেকে আলাদা করে দেওয়া হতো।৮ আর এটা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ প্রার্থণা করত।৯
কিছুদিন আগের করোনা বা কিছুদিন পরপর মহামারিগুলো আমাদের বারবার কিন্তু একই ব্যাপার স্মরণ করিয়ে দেয়- মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা। ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হতেই থাকে, তাই না?