ছোটবেলায় আমরা কম-বেশি সবাই দুষ্টুমি করেছি। মাঠে-ঘাটে, খেতে-শুতে সবখানে। যেখানে নিজেদের মতো দুষ্টুমি করার, মজা করার সু্যোগ পেয়েছি সেই জায়গাগুলোকে আপন মনে হয়েছে। সুযোগ পেলেই সেখানে গিয়েছি। বিকেল হতে না হতেই ছুটে গিয়েছি মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলতে, পার্কে দোলনায় চড়তে বা স্লাইড দিয়ে পিছলে নামতে। দৌড়ঝাঁপ করে হাত-পা ভাঙলেও ঘরে মন টেকেনি। পাড়ার যে ভাইয়েরা আমাদের খেলায় নিতেন, যে আংকেলরা দুষ্টুমির জন্য আমাদের বকাঝকা করতেন না, তাদের বরাবরই আপন মনে হয়েছে। তাদের প্রতি বিতৃষ্ণার বদলে বেড়েছে সম্মান। কখনো ক্রিকেট খেলায় নেওয়ার আবদার নিয়ে ছুটে গিয়েছি সেই ভাইয়াদের কাছে। দুধভাত হিসেবে হলেও খেলায় নিয়েছেন। নিতে না পারলে পরের দিন অবশ্যই নিবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তাই খেলার মাঠের প্রতি অনীহা জন্মেনি, সেখানে যেতে বিরক্ত লাগেনি। সেই আংকেলদের দেখে কখনো ভয় লাগেনি, পালিয়ে যেতে হয়নি। আপন জায়গাগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করছি আজও।

স্বভাবতই মসজিদেও দুষ্টুমি করেছি। জামাআতের শেষ কাতার ছিল আমাদের রাজত্ব। তাকবীরের পরেও দুষ্টুমি-খুনসুটি, রুকুতে গিয়ে সালাত ধরা, সালাতের মধ্যে একে অপরকে চিমটি কাটা, খোচা দেওয়া, হাসি চেপে রাখা, সালাম ফিরিয়েই চিমটি-খোচার প্রতিশোধ নেওয়া। মুসল্লিরা বিরক্ত হয়েছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু কেউ কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে বলেননি, সালাত চলাকালীন দুষ্টুমি না করতে। বরং বকাঝকা করেছেন। আমার মনে আছে, রমাদানে তারাবীহর সময় আমাদের দুষ্টুমি বেড়ে যেত। বছরের ঐ একমাস সন্ধ্যের পর লম্বা একটা সময় বাসার বাইরে থাকা যেত। অন্যান্য সময় তা ঘুণাক্ষরেও সম্ভব না। সু্যোগ পেলে কে ছাড়ে! তাই শেষ কাতারে দুষ্টুমির হারটা রমাদানে স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধি পেত। মুসল্লিরা বিরক্ত হতেন। দু’রাকাত পরপর পেছনের দিকে গরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার দাঁড়িয়ে যেতেন বেশিরভাগ। তবে জাঁদরেল স্বভাবের আংকেলগুলো সালাত শেষে আমাদের বকাঝকা করতেন, বাসায় নালিশ পাঠানোর হুমকি দিতেন। বলতেন, মসজিদে যেন না আসি। আমাদের মনে হতে লাগল, মসজিদটা যেন আমাদের আপন না। এখানে রাজত্ব ওই জাঁদরেল আংকেলগুলোর। একটু দুষ্টুমি করলেই এখানে বকা খেতে হয়, বাসায় নালিশ চলে যায়। মসজিদে থাকার সময়টা বিশ রাকাত থেকে কমে আট রাকাতে নেমে এলো। এরপর চলে যেতাম আমাদের আপন জায়গায়- মাঠে বা পার্কে। এভাবেই ছোটবেলায় মসজিদকে আপন করে পাওয়া হয়নি; বরং জন্মেছিল সুপ্ত বিতৃষ্ণা। অভাব ছিল একটু সহানুভূতির, একটু বুঝিয়ে বলার।

মসজিদ প্রেমী

বেশ কিছুদিন আগে এক পরিচিত ভাই একটা ফেসবুক গ্রুপের সন্ধান দিলেন। গ্রুপটায় ঘুরে আসতে বললেন। বেশ, ফেসবুকে গ্রুপটা খুঁজে পেলাম। গ্রুপে ঢুকতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। দেখলাম, মানুষজন তাদের মসজিদ কেন্দ্রিক আয়োজনগুলো সেখানে শেয়ার করছেন। কোথাও মসজিদে বইপড়া প্রতিযোগিতা হচ্ছে, কোথাওবা কুরআন তিলাওয়াত বা কুইজ, ঝুড়িতে বল ফেলা প্রতিযোগিতাসহ সহ আরও নানান আয়োজন। তবে সবচেয়ে চমৎকার বিষয় হলো এ সব কিছুই করা হচ্ছে মসজিদে ছোট বাচ্চাদের নিয়ে। বেশ মজার না!

গ্রুপটির নাম ‘মসজিদ প্রেমী’।[১] গ্রুপটা চালান মুনতসির মামুন নামে এক ইঞ্জিনিয়ার ভাই। তিনি তার এলাকার মসজিদের বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে বেশ কাজ করেন। সেগুলো গ্রুপে শেয়ার করেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা মসজিদ প্রেমীরাও তাদের মসজিদ কেন্দ্রিক আয়োজনগুলো শেয়ার করেন। সব আয়োজনগুলোর উদ্দেশ্য আমাদের ছোট ভাইবোনদের, এলাকার বাচ্চাদের মসজিদমুখী করা। মসজিদকে তাদের আপন করে তোলা। 

মসজিদ প্রেমীদের কর্মকাণ্ড

 আয়োজনগুলো হয়ে থাকে সাপ্তাহিক, মাসিক বা উৎসব কেন্দ্রিক। সাপ্তাহিক একদিন জুমুআর পর আয়োজন করা হয়। আয়োজনের মধ্যে থাকে—

  • মসজিদের সামনে পরস্পরের খোঁজখবর নেওয়া, সামাজিক সম্প্রীতি
  • মসজিদের অনুষ্ঠানের শুরুতে কুরআন তিলাওয়াত
  • বই পড়া ও শোনা
  • বই থেকে প্রশ্নোত্তর ও বিজয়ী ঘোষণা
  • দান করার কয়েনের খেলা ও বিজয়ী নির্ধারণ
  • বিজয়ীদের পুরস্কার বিতরণ
  • সবার মাঝে চকলেট বিতরণ
  • লাইব্রেরির আগের সপ্তাহে ইস্যু করা বই ফেরত নেওয়া ও বই পড়ার পুরস্কার প্রদান
  • লাইব্রেরির সাপ্তাহিক বই ইস্যু করা

মাসিক আয়োজনের মধ্যে থাকে পুরো মাস জামাআতে সালাত আদায় করার জন্য বাচ্চাদের পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান। এছাড়াও ঈদ কেন্দ্রিক আয়োজনও আছে। এ বছর ঈদুল ফিতরের আয়োজনে ছিল—

  • বাচ্চারা সবাই মিলে মসজিদ ও আঙ্গিনা সাজানো
  • ঈদের জামাআতে আসা ছোট মেয়েদের উপহার হিসেবে চুলের ক্লিপ, ব্যান্ড দেওয়া
  • জামাআত শেষে মসজিদের বাইরে বাচ্চাদের উপহার হিসেবে আতর, ঈদ সালামি হিসেবে নতুন টাকার নোট, স্টিকার দেওয়া
  • জামাআত শেষে সবাই কোলাকুলি, সবার মাঝে চকলেট বিতরণ
  • মসজিদ থেকে সবাই মিলে ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে তাকবীর দিতে দিতে এবং ফিলিস্তিনি ভাই-বোনদের প্রতি একাত্মতা প্রদর্শন করে আনন্দ পদযাত্রা
  • মসজিদে সবাই একত্র হয়ে বই পড়া, শোনা এবং কুইজ আয়োজন
  • দানবাক্সে কয়েন ঢোকানো খেলা
  • একত্র হয়ে ইমাম সাহেবের নসীহত শোনা ও পুরস্কার বিতরণী
  • উপস্থিত অভিভাবক ও অতিথীদের বই উপহার দেওয়া এবং পরবর্তীতেও এমন কাজ করতে পারার জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করা

ঈদুল আযহার আয়োজনে ছিল—

  • হজ উপলক্ষে বাচ্চাদের মাঝে মক্কা ও মদীনার স্টিকার বিতরণ
  • সবাই মিলে তাকবীরে তাশরিক ও তালবিয়া পাঠ
  • মসজিদ সাজানোর জন্য সবাই মিলে কাগজের ফুল ও অন্যান্য সরঞ্জাম তৈরি 
  • ঈদ উপলক্ষে মসজিদ সাজানো
  • ফিলিস্তিনি ভাই-বোনদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্য র‍্যালি
  • ঈদের দিন মসজিদে বাচ্চাদের মধ্যে ঈদ কার্ড/স্টিকার, চকলেট ইত্যাদি উপহার সামগ্রী বিতরণ

এছাড়া গ্লোবাল ওয়ার্মিং, আবহাওয়া পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে বৃক্ষরোপণ ক্যাম্পেইন করার পাশাপাশি এমন আরও সুন্দর সুন্দর, ক্রিয়েটিভ আয়োজন করেন এবং শেয়ার করে থাকেন গ্রুপের মেম্বাররা। 

একটি আবেদন

কয়েক বছর আগে একটা নিউজ বেশ প্রচার হয়েছিল। তুরস্কের ইস্তাম্বুলের সুলতান সেলিম মসজিদে যে বাচ্চারা টানা একমাস ফজরের সালাত জামাআতে এসে পড়েছে, তাদের সকলকে সাইকেল উপহার দেওয়া হয়েছিল।[২] এমনটা করা হয়েছিল যেন বাচ্চারা মসজিদে আসতে অনুপ্রাণিত হয়। আমাদের দেশে এখন এমন কাজ খুব বেশি জরুরি। মসজিদ ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের আপন হলে তাদের পরবর্তীতে মসজিদ পাঠানোর জন্য জোর করতে হবে না। সেই সাথে মসজিদে এই ধরনের আয়োজন করে তাদের সুস্থ বিনোদনে মাধ্যম তৈরি করা যাবে। মসজিদের প্রতি তাদের বিতৃষ্ণা তৈরি হবে না। তারা একটি সহানুভূতিশীল পরিবেশ পাবে।

তবে এই কাজটা করতে হবে তোমাকে-আমাকে। অন্য কেউ করবে এমন আশা করে বসে থাকলে চলবে না৷ উদ্যোগ নিতে হবে আমাদেরই। তুমি তোমার সামর্থ্য অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব করো। এলাকার ছোট ভাইগুলোকে পাঁচ ওয়াক্ত জামাআতে সালাত পড়ার জন্য ছোট একটা চকলেট গিফট করতে পারো। সম্ভব হলে পাড়ার মসজিদে ছোটখাটো একটা লাইব্রেরি করতে পারো। এজন্য মসজিদে ইমাম সাহেবের সাথে পরামর্শ করে তাঁর সাহায্য নিতে পারো। তাদের নিয়ে কুরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারো এবং বিজয়ীদের পুরস্কৃত করতে পারো। লাইব্রেরির বই থেকে বা ষোলো ম্যাগাজিন কুইজ প্রতিযোগিতারও আয়োজন করতে পারো। করতে পারো ঈদ কেন্দ্রিক নানা আয়োজন। নিজ থেকে নতুন নতুন ক্রিয়েটিভ আইডিয়া বের করতে পারো। কী করতে পারো বুঝতে না পারলে ‘মসজিদ প্রেমী’ গ্রুপে ঢুকে দেখতে পারো দেশের অন্য প্রান্তের মসজিদ প্রেমীরা তাদের মসজিদে কী আয়োজন করছে। এই কাজে তোমার বন্ধু, পাড়ার পরিচিত বড় ভাই কিংবা আংকেলদেরও সাহায্য নিতে পারো। 

চলো, সবাই মিলে আমাদের মসজিদগুলোকে আপন করে তুলি। তুমিও চাইলে পারো একজন মসজিদ প্রেমী হতে। তবে আর দেরি কেন? কোমর বেঁধে আজই নেমে পড়ো কাজে। 


১. http://www.facebook.com/groups/mosjidpremi 

২. https://youtu.be/L4mssZ2Di4c?si=F6k_L7XXnzl8rlFF