রেলস্টেশনে জীবনের কতগুলো করুণ, কুৎসিত এবং নির্মম বিষয় খুব স্পষ্টভাবে জানান দেয় তাদের উপস্থিতি।
জয়দেবপুর স্টেশনে এক ভিক্ষুক দেখলাম, পা দুটো শুকিয়ে গেছে, অপুষ্টির শিকার। মাটিতে কোমর ছেঁচড়িয়ে হাচরপাচর করে হাঁটছে। এক তরুণ ঝালমুড়িওয়ালার কাছ থেকে পাঁচ টাকার মুড়ি কিনে তাকে দিল। সেই অসহায় লোকটার হাত প্রচণ্ড কাঁপছিল। সে যতটা না মুড়ি খেল তারচেয়ে বেশি মুড়ি মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নষ্ট করল।
আরেক ভিখারী ছেঁড়া জামা (ন্যাকড়া বলা উচিত) গায়ে ওয়েটিং রুমে বসে আছে তার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে। সম্পত্তির পরিমাণ অবশ্য খুব বেশি না। একটা পলিথিনের বস্তা, ২-৩ টা প্লাস্টিকের বস্তা, রাস্তা থেকে কুড়ানো কিছু কোমল পানীয়ের বোতল আরও হাবিজাবি অনেক কিছু। কতদিনের অভুক্ত কে জানে!
ভরদুপুরে কমলাপুর স্টেশনে এক পিচ্চি কুলির সাথে কথা বলেছিলাম গত বছর। আমার মালপত্রের ভার বহন করতে পারবে না জানা সত্ত্বেও, সে শুধু দুপুরের খাবার টাকা জোগাড় করার জন্য আমার কাছে এসে কাকুতিমিনতি করল, তাকে যেন কুলি হিসেবে নিই। পরে জেনেছিলাম, তার বাবা রিকশাচালক, মা গৃহকর্মীর কাজ করে। সকাল থেকে না খেয়ে আছে। পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে কি না জিজ্ঞাসা করাতে সে আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। আমি প্রাণহীন, ট্রেনের অপেক্ষমান স্টেশনে স্থবির হয়ে বসে ছিলাম।
বিশ্বব্যাপী শিশুশিক্ষা, ক্ষুধা নিবারণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়ে অনেক গালভরা কথা আমরা শুনতে পাই। MDG, SDG বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। এসি রুমে বসে মুরগির ঠ্যাং চিবুতে চিবুতে অনেক অনেক জ্ঞানের কথা বলেন বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয় না। দিন দিন ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা, গলিবয় রানাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
ষষ্ঠ শতাব্দীতে জাযিরাতুল আরবে উমার নামে একজন লোক ছিলেন। এই ভদ্রলোক অর্ধপৃথিবী শাসন করতেন। ছিলেন আমীরুল মুমিনীন। বিশ্বাসীদের নেতা। এক রাতে তিনি অভুক্ত শিশুদের ক্ষুধা নিবারনের জন্য নিজ কাঁধে আটার বস্তা বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর নিজ হাতে রান্না করে তাদের খাইয়েছিলেন। তিনি বলতেন, ফুরাত নদীর তীরে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে মারা যায়, তাহলে আমাকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। রাদিয়াল্লাহু আনহু।
আমরা এইসব মহামানবদের ভুলে গিয়ে এমন সব লোকদের পা চাটছি, জীবনের রোল মডেল বানাচ্ছি, যারা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট!