জুলাই আন্দোলনের পরে বিদেশে পড়াশোনা এবং গবেষণার জন্য যাওয়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আওয়াজ উঠিয়েছেন, পরিবর্তিত বাংলাদেশে ফিরে এসে তারা দেশ ও দেশের মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে চান। কিন্তু খুব শীঘ্রই তাদের এই ইচ্ছায় ভাঁটা পড়ে। কারণ, স্বৈরাচার হাসিনা পতনের পরে বাংলাদেশের স্থবির শিক্ষা ও গবেষণা খাত যেমন গতিশীল হবে ভেবেছিল তারা, তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। কাঠামোটা সেই আগেই মতোই। তারা আবার বিদেশে থাকাকেই উপযুক্ত মনে করছেন।

বাংলাদেশের মেধাবী মাথাগুলো বাইরে পড়ে আছে এখন। কারণ, এখানে শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নত না। দুনিয়ায় পিছিয়ে থাকা যতগুলো শিক্ষাখাত আছে, বাংলাদেশ এখন তার মধ্যে অন্যতম। ব্রিটিশ-আগ্রাসন পরবর্তী সময়ে অন্যান্য দিকগুলোর মতো শিক্ষাব্যবস্থায়ও ধ্বস নেমেছে। অথচ, ব্রিটিশ-পূর্ববর্তী সময়ে এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা ছিল বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা। এখন যেমন বাংলাদেশীরা বাইরে যায় মানসম্মত শিক্ষার আশায়। একসময় এই অঞ্চলেও বাহির থেকে বড় বড় স্কলাররা আসতেন শিক্ষা নিতে এবং দিতে।

কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? আজকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্য। এমন একটা সময় ছিল, যখন দূর-দূরান্ত থেকে জ্ঞানীরা এখানে আসতেন, শেখাতেন, লিখতেন, নতুন নতুন জ্ঞান আবিষ্কার করতেন। কীভাবে তা হলো? চলো দেখি!

তখন এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত মাদরাসা নামেই পরিচিত ছিল। কিন্তু এই ‘মাদরাসা’ মানে আজকের সেক্যুলাররা যেরকম মাদরাসাকে অবজ্ঞা করে, এরকম কিছু না। এখানে শুধু ধর্মীয় পড়াশোনা নয়, এখানে বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, দর্শন—সব পড়ানো হতো!

এর পাশাপাশি হিন্দুদের ছিল টোল, গুরুকুল, বিদ্যামন্দির ইত্যাদি নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বৌদ্ধদের ছিল বিহার। এগুলোতেও তাদের নিজ নিজ ধর্মশিক্ষার পাশাপাশি দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণশাস্ত্র ইত্যাদি পড়ানো হতো।

বাংলার ইতিহাসে শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা বিকাশের ক্ষেত্রে মুসলিম শাসকদের ভূমিকা ছিল অসামান্য। মধ্যযুগে বাংলায় মাদরাসার প্রচলন ঘটে, যা কেবল ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, গণিত, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চারও এক বিশাল কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

বাংলায় মাদরাসা শিক্ষার প্রচলন শুরু হয় মুসলিম শাসনামলে, বিশেষত সুলতানি আমলে। ১৩শ শতাব্দীতে সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের (১২২৭-১২২৯) সময় বাংলায় প্রথম বৃহৎ মাদরাসাগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব মাদরাসা ছিল জ্ঞান-বিকাশের প্রাণকেন্দ্র, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন শাস্ত্রেরও পাঠদান করা হতো।

গুরুত্বপূর্ণ মাদরাসাগুলোর অবস্থান:

সোনারগাঁ: এটি ছিল বাংলার অন্যতম প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র, যেখানে ধর্মীয়, সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের চর্চা হতো।

লক্ষণাবতী (গৌড়): বাংলার রাজধানী হওয়ায় এটি শিক্ষার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

পান্ডুয়া: ইতিহাসে এই জায়গাটি শিক্ষার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল, যেখানে বহু আলিম ও পণ্ডিত বসবাস করতেন।

বগুড়া: এখানেও মাদরাসা গড়ে ওঠে, যা জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল।

বাংলার মাদরাসা শিক্ষার বহুমুখিতা

অনেকের ধারণা, মাদরাসার শিক্ষা মানেই শুধু কুরআন, হাদীস বা ফিকহ পাঠ। কিন্তু মধ্যযুগে বাংলার মাদরাসাগুলোতে বিজ্ঞান ও অন্যান্য শাস্ত্রও সমানভাবে গুরুত্ব পেয়েছিল। ১৩৮৯ সালে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলায় এসে দেখেছিলেন, কীভাবে বাংলার শাসক ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ শিক্ষার প্রসারে মাদরাসার উন্নয়ন করছিলেন।

পাঠ্যবিষয় ও গবেষণা

গণিত: মধ্যযুগীয় বাংলার মাদরাসাগুলোতে গণিত চর্চার বিশেষ গুরুত্ব ছিল।

জ্যোতির্বিদ্যা: মুসলিম শাসনামলে জ্যোতির্বিজ্ঞান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, যা নৌপরিবহন ও কৃষির জন্য ব্যবহৃত হতো।

দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা: ইসলামী দর্শনের পাশাপাশি গ্রিক ও ভারতীয় দর্শনও এখানে আলোচিত হতো।

ঔষধশাস্ত্র: তিব্বতীয় ও ইউনানি চিকিৎসাব্যবস্থার প্রচলন বাংলার মাদরাসাগুলোতে শিক্ষাদানের অংশ ছিল।

ইতিহাস ও ভূগোল: মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস এবং বিভিন্ন অঞ্চলের ভূগোল শেখানো হতো।

জ্ঞানচর্চার প্রসারে শাসকদের অবদান

বাংলার মুসলিম শাসকরা কেবল সামরিক ও প্রশাসনিক দিকেই মনোযোগী ছিলেন না, বরং শিক্ষার বিকাশেও তারা যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন। ১৫শ শতাব্দীতে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৯) শাসনামলে শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তার ঘটে, এবং অনেক বিদ্বান ব্যক্তিত্ব মাদরাসাগুলোর সাথে যুক্ত হন।

বিশেষত, গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৯০-১৪১০) ও আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বিভিন্ন পণ্ডিত ও কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ফলে বাংলা সাহিত্যেও এই সময় উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। মধ্যযুগীয় বাংলার কবি আলাওল, দৌলত কাজীর মতো সাহিত্যিকরা তাদের লেখায় ইসলামী ও দার্শনিক চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটান।

বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা এতটাই উন্নত ছিল যে, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞানপিপাসুরা এখানে আসতেন। গৌড় ছিল একসময় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম কেন্দ্র। সপ্তগ্রাম, সোনারগাঁ ও পান্ডুয়া ছিল তৎকালীন সময়ে বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র।

 শুধু শিক্ষাব্যবস্থা-ই নয়, এখানে ছিল এক সমৃদ্ধ শিল্পব্যবস্থাও।


সহায়ক গ্রন্থসমূহ:

  1. Richard M. Eaton, The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204–1760, University of California Press, 1993.
  2. Syed Ejaz Hussain, The Bengal Sultanate: Politics, Economy and Coins (AD 1205-1576), Manohar Publishers, 2003.
  3. Abdul Karim, Social History of the Muslims in Bengal, Asiatic Society of Bangladesh, 1985.
  4. Muhammad Mohar Ali, History of the Muslims of Bengal, Imam Muhammad ibn Saud Islamic University, 2002.
  5. Syed Nurul Hasan, Thoughts on the Education System in Medieval India, Calcutta University Press, 1969.