আজ আমরা বাংলার যে রূপ দেখি, সেটাকে ‘সোনার বাংলা’ বললেও, সত্যিই কি তা সোনার মতো? এখনকার বাংলার অবস্থা কেমন? ভাঙ্গাচোরা অর্থনীতি, অন্য দেশের উপর নির্ভরশীল রাজনীতি, এবং নিজেদের সংস্কৃতি ও স্বকীয়তা হারানো পরনির্ভরশীল এক জাতি। এবং বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে একটি—উন্নয়নের জন্য বিদেশি সাহায্যের দিকে যার তাকিয়ে থাকতে হয়। আমরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে পারি না, বরং অন্য দেশের লোকেরা এসে ঠিক করে দিয়ে যায় আমাদের জন্য কোনটা ভালো কোনটা খারাপ।

কিন্তু বাংলা কি সবসময় এমন ছিল? 

একদম না! বরং আজকের বাংলার এই অবস্থা দীর্ঘদিনের শোষণের ফল। বাংলা আসলেই একসময় ‘সোনার বাংলা’ ছিল। তখন অবশ্য এটাকে ‘বাংলা’ বলা হতো না, বলা হতো ‘বাঙ্গালা’।

এই প্রবন্ধে আমরা জানবো কীভাবে মুসলিমদের নেতৃত্বে বাঙ্গালার উত্থান ঘটেছিল এবং ধীরে ধীরে কীভাবে তা বিশ্বের এক সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল।

ইসলামের আগমন

তেরো শতকের কথা। তখন এখানে শাসক ছিলেন হিন্দু রাজা লক্ষণ সেন। ১২০৪ সালে সাহসী তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলায় আসেন। তার নেতৃত্বে লক্ষণ সেনের বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলা বিজয়ের মাধ্যমে এখানে মুসলিম শাসনের যাত্রা শুরু হয়।

রাজনৈতিক রূপান্তর

মুসলিম শাসনের আগমনে বাংলার শাসনব্যবস্থা এক নাটকীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। আগে বাংলায় ছোট ছোট রাজারা নিজেদের ছোট রাজ্যগুলো নিয়ে সবসময় ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত থাকতেন। এসব রাজ্যগুলোর মধ্যে কোনো মিল ছিল না, ফলে শাসনব্যবস্থা ছিল অস্থিতিশীল। এই অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে বাঙ্গালার ব্যবসা-বাণিজ্যও স্থবির হয়ে ছিল।

কিন্তু মুসলিম শাসকরা যখন আসেন, তখন তারা বাংলাকে একত্র করে এক শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত (centralized) শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের নেতৃত্বে বাংলায় স্থিতিশীলতা আসে।

সামাজিক রূপান্তর

মুসলিম শাসকদের আগমনে শুধু রাজনীতি নয়, বাংলার সমাজেও এক বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। আগে বাংলার সমাজ ছিল হিন্দুদের বর্ণব্যবস্থার কঠোর নিয়মে আবদ্ধ। যেখানে মানুষকে তাদের জাতপাতের ওপর ভিত্তি করে বিচার করা হতো।  উঁচুজাতের মানুষদের হাতে নিচুজাতের মানুষেরা নির্যাতিত হতো।  কিন্তু মুসলিম শাসকরা এসে সেই কঠোর ব্যবস্থার পরিবর্তে এমন একটি সমাজ তৈরি করেন, যেখানে সব ধর্মের মানুষ তাদের নিজ নিজ ধর্ম নিয়ে শান্তিতে থাকতে পারত। মুসলিম শাসকদের এই সহাবস্থানমূলক সমাজ কাঠামো বাংলার সমাজকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল। বাংলার সমাজে শান্তি, সম্প্রীতি এবং সহমর্মিতার বাতাবরণ তৈরি হয়, যা সবাইকে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকার সুযোগ করে দেয়।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন

মুসলিম শাসকদের অধীনে বাংলার অর্থনীতি এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। আগে বাংলায় প্রচুর উর্বর জমি থাকলেও, পুরোনো শাসকদের শাসন ব্যবস্থায় এগুলোকে কাজে লাগানো যায়নি। কিন্তু মুসলিম শাসকরা এসে কৃষিক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন।

তারা সেচ ব্যবস্থা উন্নতি করেন, যাতে কৃষকরা সহজে জমিতে পানির ব্যবস্থা করতে পারে। নতুন নতুন পদ্ধতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। বিশেষ করে ধান, পাট, এবং অন্যান্য অর্থকরী ফসলের চাষ বাড়াতে শুরু করেন।

কৃষির উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাওয়ার ফলে খাদ্য উৎপাদনও বাড়ে, এবং কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। অর্থাৎ, যারা কৃষিকাজ করে তাদের জীবন হয়ে ওঠে সুখময়।

বাঙ্গালার অর্থনীতি কৃষি প্রধান হওয়ায় ধীরে ধীরে এটি শক্তিশালী হতে শুরু করে। কৃষির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শিল্পেরও বিকাশ ঘটে। মুসলিম শাসকদের নতুন বাণিজ্যনীতির ফলে বাংলার অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও ব্যাপক উন্নতি ঘটে। ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রমশ ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে, আর এভাবে বাংলার অর্থনীতির ভিত্তি শক্তিশালী হয়। মুসলিম শাসনের সময়ে অর্থনৈতিক উন্নতি বাংলাকে বিশ্ব বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে।

প্রশাসনিক সংস্কার

মুসলিম শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল প্রশাসনিক ও করব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা। প্রশাসনিক কাঠামোকে নতুনভাবে সাজানো হয়, যাতে রাজ্য পরিচালনা আরও সুশৃঙ্খল ও কার্যকরী হয়।

নতুন শাসনব্যস্থায় জমির কর কীভাবে নির্ধারণ করা হবে, কীভাবে কর সংগ্রহ করা হবে এবং সরকারের বিভিন্ন স্তরে কীভাবে কার্যকর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হবে—এসব বিষয় নিয়ে নতুন নিয়মাবলী গঠিত হয়।

এই সংস্কারগুলো শুধু সরকারের কাজকে সহজই করেনি; বরং কৃষি এবং বাণিজ্যের উন্নতির পথও তরান্বিত করেছিল। এর ফলে বাংলায় দীর্ঘমেয়াদী সমৃদ্ধি নিশ্চিত হয়।

মোটের উপর, ইসলামের আগমনের ফলে বাংলায় যে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয়, তা একটি স্থিতিশীল এবং সমৃদ্ধশালী সমাজের ভিত্তি স্থাপন করে। মুসলিম শাসকরা বাংলার মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ ও উন্নত করে, এবং সেই সময় বাংলার উন্নয়নে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

চলবে ইনশাআল্লাহ…

রেফারেন্স:

১. Eaton, R. M. (1993). The rise of Islam and the Bengal frontier, 1204–1760. University of California Press.

২. Habib, I. (1999). The agrarian system of Mughal India, 1556–1707 (2nd ed.). Oxford University Press.

৩. Karim, A. (1959). Social history of the Muslims in Bengal (1st ed.). Pakistan Historical Society.

৪. Majumdar, R. C. (1943). The history of Bengal, Volume II: Muslim period, 1200–1757. University of Dhaka.

৫. Raychaudhuri, T., & Habib, I. (Eds.). (1982). The Cambridge economic history of India, Volume 1: c.1200–c.1750. Cambridge University Press.

[ষোলো জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত]