এই তো সেদিন, মনে পড়ে কি ইন্টারনেটবিহীন দিনগুলোর কথা?

ছোটবেলায় পড়েছিলাম, যুদ্ধের সময় মানুষ সারাক্ষণ রেডিও নিয়ে বসে থাকত। কিন্তু কেন, তা বুঝতাম না। বিগত বছরের দিকে ফিরে তাকালে বুঝি, ছোট্ট একটা সংবাদের জন্য রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা করেছি, বন্ধুরা কেমন আছে-কোথায় আছে-কী করছে, দেশের কী হবে, যারা রাস্তায় আছে তাদের ভবিষ্যতের কী হবে—এসব ভেবে রাতের পর রাত ঘুমাইনি। অবিশ্বাস্য!

যারা বলত—জেন-জি আত্মকেন্দ্রিক, নিজেদের ছাড়া কিছুই ভাবে না, চেনে না, ৩৬ জুলাই তাদের মুখে চপেটাঘাত। অন্যায় কোটার বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে গিয়েও যে জীবন দিয়ে দিতে হবে, জীবন যে এতটা সস্তা, সেটা কেউ কি ভেবেছিল কখনো? কেউ কি ভেবেছিল নিরস্ত্র মেধাবী তরুণ সমাজকে রক্ত দিতে হবে কেবল ন্যায়ের পক্ষে কথা বলবার জন্য? শব্দ বনাম বন্দুক—এ কেমন অসম লড়াই?

আজ আমরা দেখব শব্দের ধ্বনি বন্ধ করবার কারিগরদের অপরাধের কিছু সত্য প্রমাণ। যদিও এ লেখায় শব্দের সীমাবদ্ধতার কারণে ৯৯% গল্পই আমাদের জানা হবে না। আনুষ্ঠানিকভাবে আগস্ট পর্যন্ত নিশ্চিত মৃতের সংখ্যা ২১৫ জন, অনানুষ্ঠানিক হিসেব ৫০০ জনের মতো। আহতের সংখ্যা ২০,০০০ এর আশেপাশে। OHCHR রিপোর্ট অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ১৪০০।ইউনিসেফের ভাষ্যে, এ আন্দোলনে নিরপরাধ অন্তত ৩২ শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে পুলিশ।

শুরুর গল্প

২০২৪ সালের ৫ জুন সুপ্রিমকোর্ট মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের জন্য সরকারি চাকুরিতে ৩০% কোটা পুনর্বহাল করে, যা ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের সময় বাতিল করা হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে ঢাকাকেন্দ্রিক শিক্ষার্থী এবং পরবর্তীতে ঢাকার বাইরের শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে থাকে। আন্দোলনে প্রথম ১০ জুলাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে ছাত্রলীগ। ঈদের ছুটি স্থগিত করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীরা, আন্দোলনের মুখে সরকার ৩০% অন্যায় কোটা স্থগিত করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা স্থায়ী সমাধানের জন্য আন্দোলন জারি রাখলে সরকারপ্রধান ১৪ জুলাই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। এ মন্তব্যের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে “তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার! কে বলেছে কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার!”  স্লোগান দিতে থাকে ছাত্ররা। পরদিন শাহবাগ থেকে কয়েকজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং গুলি চালায়। রোকেয়া হলের ছাত্রীরা তালা ভেঙে আন্দোলনে যোগ দেয়। সরকারের ছত্রছায়ায় ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাংচুর ও সাধারণ ছাত্রদের উপর হামলা করে। ১৫ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকশত ছাত্র-ছাত্রী আহত হয়। যারা ভিডিও ধারণ করছিল, তাদেরকেও হলে ডেকে মারধর করা হয়।

১৬ জুলাই রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদকে আন্দোলনরত অবস্থায় পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। মাত্র ১৫ মিটার দূরত্বে দু’জন পুলিশ তাকে শটগান দিয়ে গুলি করে। আবু সাইদ তবু বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু পুলিশের কাছে মেধাবীদের জীবন ছিল খেলনার মতোই!

রক্ষক যখন ভক্ষক

জুলাই আন্দোলনে পুলিশের নির্বিচার হত্যা, গুম এবং শারীরিক নির্যাতন ছিল পৈশাচিক। লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস, প্রথম দিকে রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড এবং স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করলেও পরে লোহার মেটাল বুলেট ব্যবহার করে পুলিশ। র‍্যাব সর্বমোট ১৫টি ব্যাটালিয়ন নামায় সারাদেশে। আনসার ও ভিডিপি যোগদান করে সাথে। বিজিবি-আনসারদের হাতে টাইপ-৫৬ এবং বিডি-০৮ রাইফেল দেখা যায় এক ভিডিওতে, যেটা কেবল দেশের ইমার্জেন্সি পরিস্থিতিতে ব্যবহারের নিয়ম। একজন মিলিটারি অফিসার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাকে বলেন, “তারা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে শ্যুট করে। একটা বুলেট = একজনের নিশ্চিত মৃত্যু।”

ছাত্রলীগ রামদা, লাঠি, হেলমেট, পিস্তল দিয়ে হামলা করে,১০ আহত ছাত্রদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেও হামলা করে ছাত্রলীগ। ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রীলীগ নেত্রীরা আন্দোলনরত মেয়ে শিক্ষার্থীদের সম্মানহানীর হুমকি দিতে থাকে, লীগের ছেলেরা মেয়েদের গায়ে গরম পানি ঢেলে দেয়, লাথি মারে এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন করে।১১ 

১৯ জুলাই রায়েরবাগে মসজিদে মুসল্লিদের উপর হামলা করা হয়, সেখানে গুলিতে দু’জন বয়স্ক ব্যক্তি মারা যায়, আহত হয় প্রায় ৮০ জন।১২ 

২০ জুলাই সরকার “মহাসড়ক পরিষ্কার” অভিযান গ্রহণ করে এবং মুহুর্মুহু গুলি করে। যাত্রাবাড়ীর কাজলায় আন্দোলনরত নিরীহ-নিরস্ত্র একজন ছাত্রকে দৌড়াতে বলে এবং সে দৌড় দিলে তাকে বুকে গুলি করে। সে কাতরাতে কাতরাতে প্রাণভিক্ষা চাইতে থাকে, কিন্তু পুলিশ শটগান দিয়ে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে।১৩

হেলিকপ্টার থেকে টিয়ার শেল এবং বুলেট নিক্ষেপ করে পুলিশ। কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে হেলিকপ্টার নামানো হয়। এ ঘটনার সাক্ষী আমি নিজেই (লেখিকা), আমাদের বাসার ওপরে অনর্গল জলপাই রঙের হেলিকপ্টার উড়তে দেখেছি, যেটা নিশ্চিত র‍্যাবের। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাও হেলিকপ্টারের ব্যবহার (আইনসঙ্গত নয়) নিশ্চিত করেছে।

গণগ্রেফতার কর্মসূচি, সাংবাদিকদের তাজা বুলেট দিয়ে গুলি করা, মিডিয়াতে কোনো সংবাদ প্রকাশ করতে না দেওয়া, সারাদেশে ইন্টারনেট শাটডাউন, এমন কোনো কাজ নেই পুলিশ-আর্মি-আনসার-বিজিবি সে মাসে করেনি।

শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন

১৮ জুলাই এমআইএসটি’র কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন আন্দোলনের এক পর্যায়ে পুলিশের এপিসি’র (আর্মড পারসোনেল ক্যারিয়ার) ওপর উঠে যায়। তার উদ্দেশ্য ছিল গাড়িটির ছাদের হ্যাচটা বন্ধ করা। কিন্তু পুলিশ তাকে শটগান দিয়ে গুলি করে। প্রথম গুলির ঠিক চার সেকেন্ড পরে আরেকজন পুলিশ তাকে পরপর তিনবার গুলি করে, ইয়ামিন এপিসির ছাদে আহত অবস্থায় ঝুলতে থাকে। পুলিশ তাকে হ্যাচ থেকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে চলে যায়। অত্যন্ত মর্মান্তিক, হৃদয় বিদারক মৃ্ত্যু ঘটে ইয়ামিনের।১৪

নারী শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন

আন্দোলনের নারী শিক্ষার্থী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়। মেয়েদের মুখ, বুক, কোমর এবং স্পর্শকাতর স্থানে টার্গেট করে আঘাত করা হয়, চুল টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় ছাত্রলীগ কর্মীরা। মেয়েদের কুৎসিত গালি দেওয়া হয়। অনবরত যৌন নির্যাতন এবং সম্মানহানীর হুমকি দিতে থাকে ছাত্রলীগ এবং ছাত্রীলীগের নেত্রীরা। আগস্টে একজন ছাত্রীকে একদল লোক এসে জিজ্ঞেস করে সে আন্দোলন করছে কিনা? জোরপূর্বক তার ব্যাগ সন্ধান করে, চুল টেনে ছিঁড়ে, বুকে খামচি দিয়ে জামা ছিঁড়ে ফেলে, স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিয়ে শারীরিক নির্যাতন করে।১৫

শিশু-কিশোরদের নির্মম হত্যা

৫ আগস্ট “মার্চ টু ঢাকা”র দিনেও গাজীপুরে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরকে গুলি করে পুলিশ। প্রায় ৫০০০-৬০০০ মানুষের জমায়েতের মধ্যেও কিশোরটির ডান হাতে গুলি করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বিক্ষোভকারীরা সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ছিল। পুলিশ বাচ্চাটিকে শ্যুট করার পরও পাথর মেরে ব্যঙ্গ করতে থাকে এই বলে যে, “এই হাতে আর পাথর ছুঁড়তে পারবি না!”

বাচ্চাটির একটি হাড়ে ৪০টির মতো গুলির অংশ পাওয়া গিয়েছে। তার টিস্যু ও হাড় ক্ষতিগ্রস্থ হয় ব্যাপকভাবে।

একই দিনে উত্তরায় বিকালে, প্রধানমন্ত্রীর পতন এবং পলায়নের পরে, উত্তাল জনতা “বিজয়” উদযাপনের জন্য রাস্তায় নেমে আসে। বাবা-মা, ভাই-বোন, পরিবার নিয়ে মানুষ আনন্দ ভাগাভাগি করে। কিন্তু পুলিশ সেসময়েও সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ করে। একটি ছয় বছর বয়সী শিশুকে নিয়ে বের হন তার বাবা-মা। নতুন বাংলাদেশের নতুন স্বপ্ন দেখাতে বের হয়েছিলেন তারা। কিন্তু নিষ্পাপ এই শিশুটিকেও পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। বাচ্চাটির উরুতে গুলি লাগে। রক্তক্ষরণের কারণে বাচ্চাটি আর বেঁচে থাকতে পারেনি, হাসপাতালেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে।

একই জায়গায় আরও একটি শিশু মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।১৬

আমার এলাকাতে একটি বাচ্চা মেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, হেলিকপ্টার থেকে আসা গুলিতে সে মৃত্যুবরণ করে। এর কোনো রিপোর্ট রাখা হয়নি।

বাঁচতে পারেনি শ্রমজীবী মানুষও

গাজীপুরে নিরস্ত্র এক রিকশাওয়ালাকে পুলিশ শটগান দিয়ে গুলি করে। এরপর তার লাশ টেনে হিঁচড়ে গুম করে ফেলে! তার পরিবার আজ পর্যন্ত লাশ খুঁজে পায়নি, কবর দিতে পারেনি, শোক করতে পারেনি। দেখতে পারেনি প্রিয়জনের মুখটাকে শেষবারের মতো!

পরিবারের একজন সদস্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাকে বলে, “আমি এর বিচার চাই! তদন্ত চাই আর লাশ ফেরত চাই!”১৭

সাধারণ মানুষের ওপর নির্মমতা

“ভ্যানের ওপর তোলা হচ্ছে একের পর এক মরদেহ; একটির ওপর আরেকটি রক্তাক্ত লাশ। মাথায় হেলমেট বুকে ভেস্ট পরিহিত কয়েকজন পুলিশ সদস্য ব্যস্ত এই কাজে। মরদেহগুলো ঢেকে দেওয়া হলো ময়লা চাদর আর রাস্তার পাশের ব্যানারে। চাদর আর ব্যানারের আড়াল থেকে দেখা যাচ্ছে হাত-পা-মাথা…”

ঢাকাপোস্টের সংবাদে উঠে আসে এক ভয়াবহ চিত্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে লোমহর্ষক ভিডিও। আশুলিয়ায় ৫ আগস্ট পুলিশের নির্বিচার গুলিতে সাধারণ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আশুলিয়া থানার সামনে ছাত্র-জনতা জড়ো হলে তাদের গুলি করতে থাকে পুলিশ। ভ্যানে করে লাশের পর লাশ বয়ে নিয়ে কোথাও লুকিয়ে ফেলে পুলিশ। নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক ছাত্র জানায়, গুলিবিদ্ধ অনেক মানুষকে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে পুলিশ।১৮

গণকবর?

ডেইলি স্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী আন্দোলনকারীদের অনেকেই এখনো নিখোঁজ, এমন ঘটনা অন্তত ৩১টি। এর মধ্যে রায়েরবাজারে “অজ্ঞাত” পরিচয়ে ৬ জনকে দাফন করা হয়েছে, আশুলিয়ায় পোড়ানো ধংসস্তুপ থেকে শনাক্ত করা গিয়েছে ৪ জনকে, আর ২ জনকে ডিএনএ টেস্ট করে শনাক্ত করা হয়েছে। বাকি ১৯ জন আজও নিখোঁজ।

আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডের দু’দিন পর, ১৮ জুলাই বিকেলে আন্দোলনে যোগ দিতে যাত্রাবাড়ীর নিজ বাসা থেকে বেরিয়ে যান ২৮ বছর বয়সী সোহেল রানা। মাকে কিছু না জানিয়ে শুধু বলেছিলেন, “অল্প সময়েই ফিরে আসব।” কিন্তু সেই যাত্রা তার জন্য ছিল শেষবারের মতো। তিনি আর বাড়ি ফেরেননি।

দ্যা ডেইলি স্টারের কাছে সাক্ষ্য দেওয়া চার আন্দোলনকারীর ভাষ্যমতে, আন্দোলনে যোগ দেওয়ার মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ সোহেলকে আটক করে। এরপর তাকে নির্মমভাবে পেটানো হয় এবং সরাসরি লক্ষ্য করে একাধিকবার গুলি চালানো হয়। পরে শাহবাগ থানা থেকে প্রাপ্ত সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, সোহেলের বুকের দুই পাশে একাধিক গুলির চিহ্ন রয়েছে এবং তার শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের দাগ স্পষ্ট।

ঢাকায় ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও আতঙ্ক দেখে পরদিনই গ্রামের উদ্দেশে রওনা দেন ১৮ বছর বয়সী কলেজশিক্ষার্থী ফয়সাল সরকার। উত্তরার আব্দুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে তিনি মাকে ফোন করেন এবং জানান যে, তিনি কুমিল্লার বাসে উঠতে যাচ্ছেন। দুর্ভাগ্যবশত, সেটিই ছিল মায়ের সঙ্গে তার শেষ ফোনালাপ। এরপর থেকে ফয়সালের আর কোনো খোঁজ মেলেনি।

এ-দিন উত্তরার আরেক এলাকায় আরও একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। গাড়িচালক ও দুই সন্তানের জনক ৩০ বছর বয়সী আসাদুল্লাহ আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কয়েকজন হেলমেটধারী সন্ত্রাসীর গুলিতে গুরুতর আহত হন।

পরে দ্য ডেইলি স্টার পুলিশি প্রতিবেদন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম ও রায়েরবাজার কবরস্থানের নথিপত্র পর্যালোচনা করে জানতে পারে—এই তিনজনের লাশ আরও অনেকের সঙ্গে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পড়ে ছিল। কারফিউ চলাকালে, স্বজনদের খোঁজ করার সুযোগ না দিয়ে ওইসব ‘অজ্ঞাতনামা’ মৃতদেহগুলোর দাফন সম্পন্ন করে হাসিনার প্রশাসন।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম (বাংলাদেশের একমাত্র অজ্ঞাত লাশ দাফনকারী সংস্থা) এর ভাষ্যমতে, ২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বরে মোট লাশ দাফন হয়েছে ৫১৫টি, গড়ে মাসে ৪৭টি করে। কিন্তু জুলাইতে লাশের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে থাকে। মাত্র ১০ দিনেই দাফন হয় ৪৫টি লাশ! যেটি পুরোমাসের গড় লাশ সংখ্যা থেকে মাত্র ২টি কম!

রায়েরবাজার কবরস্থানে সারিসারি লাশ পাওয়া যায়, যার কোনো নামফলক নেই। এখানে জুলাইয়ের শহীদ অজ্ঞাত লাশ ৪০টি।

সোহেল রানা, বয়স ২৮ এর মতো। যাত্রাবাড়ীর বাসা থেকে ১৮ জুলাই আন্দোলনে যোগ দিতে বের হয়েছিলেন, কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ তাকে আটক করে নির্যাতনের পর গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাকে ২৪ জুলাই কারফিউয়ের মধ্যেই ‘অজ্ঞাতনামা’ হিসেবে রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়।

ডেইলি স্টারের সাংবাদিকরা সোহেলের বাসায় যান। মা রাশেদা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকেন,

আমার সোহেল যে রাতে নিখোঁজ হইল, আমি সারা রাত দরজা খোলা রাখছি। ভাবছিলাম রাতেই কোনো এক সময় ফেরত আসবে। সোহেল আর আসলো না। এখন ওর কবরটাও খুঁজে পাইনি আমরা।’ ১৯

১৯ জুলাই, আন্দোলনে অংশ নিতে বড় ভাই আব্দুল জব্বারের সঙ্গে মোহাম্মদপুর টাউন হলের সামনে আসেন মাহিন মিয়া। তবে সেদিন জব্বার বাড়ি ফিরলেও মাহিন আর ফেরেননি। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ মেলেনি।

ভাইয়ের সন্ধানে অনেকদিন ধরে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছেন জব্বার। শেষমেশ ৫ আগস্টের পর কাকরাইলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কার্যালয়ে টানানো শতাধিক মৃতদেহের ছবির মধ্যে একটিতে মাহিনকে শনাক্ত করেন তিনি।

মাহিন নিখোঁজ হওয়ার ১৫ দিনের মাথায়, ৩ আগস্ট—এক দফা দাবি ঘোষণার দিন—তার স্ত্রী একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। সেটিই ছিল তাদের প্রথম ও একমাত্র সন্তান।

এই প্রতিবেদকের হাতে পাওয়া মাহিনের ময়নাতদন্ত রিপোর্টে দেখা গেছে, তাকে 'অজ্ঞাতনামা' মৃতদেহ হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছিল। রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯ জুলাই তার মাথার দু’পাশে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তার মৃতদেহ পাওয়া যায়।২০

৫ই আগস্ট যেদিন, জালিম পালিয়ে যায়, সেদিনও শহীদ হয়েছে অনেকে। নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বুকে নিয়ে জীবন দিয়েছে হাজারো মানুষ, আহত হয়েছে হাজার-হাজার মানুষ। আদর করে ৫ তারিখকে মানুষ আগস্ট ডাকেনি, ডেকেছে জুলাই হিসেবেই- ৩৬শে জুলাই। যারা আমরা সুস্থভাবে বেঁচে আছি, তারা শ’য়ে শ’য়ে মানুষের এই ত্যাগ, এই জীবন হারানো অথবা বিকলাঙ্গ হয়ে আজীবন কাটিয়ে দেওয়া, এর হিসেব দিতে পারব তো?


রেফারেন্স:

১. July massacre. In Wikipedia. https://tinyurl.com/48jsrnzc

২. Dhaka Tribune. (2025, February 12). UN report: 1,400 people killed in July uprising. https://tinyurl.com/34u5w7xa 

৩. 2024 Bangladesh quota reform movement. In Wikipedia. https://tinyurl.com/y7rxzf2w 

৪. প্রাগুক্ত

৫. Amnesty International. (2024, August 2). What is happening at the quota-reform protests in Bangladesh? https://tinyurl.com/34s2k9k6 

৬. OHCHR রিপোর্ট, ধারা: ৬৬

৭. OHCHR রিপোর্ট, ধারা: ৩৯

৮. OHCHR রিপোর্ট, ধারা: ৬৩

৯. FFTB-INT-0203, OHCHR রিপোর্ট, পৃষ্ঠা: ০৭

১০. OHCHR রিপোর্ট, ধারা: ৮৫

১১. OHCHR রিপোর্ট, ধারা: ৮৬-৮৭

১২. OHCHR রিপোর্ট, ধারা: ৯৩

১৩. OHCHR রিপোর্ট, পৃষ্ঠা: ৩২

১৪. শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন. In Wikipedia. https://tinyurl.com/2xxck5tt 

১৫. OHCHR রিপোর্ট, পৃষ্ঠা: ৫০

১৬. OHCHR রিপোর্ট, পৃষ্ঠা: ৩৪-৩৫

১৭. OHCHR রিপোর্ট, পৃষ্ঠা: ৩৫

১৮. Dhaka Post. (2024b, August 31), ভ্যানে লাশের স্তূপের ঘটনা আশুলিয়ার, ঘটনাস্থলে ছিলেন ডিবির আরাফাত, https://tinyurl.com/3wztm376

১৯. Mijan, M. (2025, March 23), কারফিউয়ের মধ্যে গণকবরে দাফন, The Daily Star Bangla. https://tinyurl.com/3vb878ch

২০. Mijan, M. (2025a, March 14), গণহত্যার প্রকৃত মাত্রা লুকানোর চেষ্টা, The Daily Star Bangla. https://tinyurl.com/8v8677bh

* OHCHR রিপোর্টটি পড়ুন এই লিংক থেকে: https://tinyurl.com/bdxypz4k