[ষোলোর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আসাদুল্লাহ আল গালিব। শ্রুতিলেখক আয়াতুল্লাহ আল কাবীর ও আজিম মাহমুদ মিরাজ।]

 ষোলো: আপনার পুরো নাম?

আরমান: আরমান হোসেন বিপ্লব।

ষোলো: আপনি এখন কী করেন?

আরমান: আমি এখন কিছুই করি না। আহত হওয়ার পর চাকরি চলে গেছে। এরপর থেকে কিছুই করি নাই।

ষোলো: আগে কী করতেন?

আরমান: ফার্মেসিতে জব করতাম।

ষোলো: পড়ালেখা কতটুকু করেছেন?

আরমান: ইন্টার (HSC) পাশ করেছি।

ষোলো: কত সালে?

আরমান: ২০২২।

ষোলো: আপনি তো সরাসরি জুলাই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, তাই না?

আরমান: জি, জি।

ষোলো: আপনি তো ঢাকায় ছিলেন। কোন এলাকায় আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন?

আরমান: আমি মিরপুর ১০ নম্বর স্টেডিয়ামের সামনে আন্দোলনে যোগ দিই।

ষোলো: কত তারিখে প্রথম আন্দোলনে গিয়েছিলেন?

আরমান: জুলাইয়ের ১৮ তারিখে আমি গুলিবিদ্ধ হই। তার আগের দিন, ১৭ তারিখ আমি প্রথম যোগ দিই। একটা স্কুলের (শিক্ষার্থীদের) সাথে আমি যোগ দিই। তখন আওয়ামী লীগের দোসররা বাহুবল প্রয়োগ করে। ১৮ তারিখ বৃহস্পতিবার, ওইদিনেই আমি তিন ধাপে গুলি খাই। প্রথম ধাপে আমি একটা বাসের সামনে ছিলাম, বাসের অন্য পাশ থেকে নিচে দিয়ে গুলি করে। তখন আমার পায়ে গুলি লাগে। ছিটা গুলি, শটগানের। এগুলা লাগার পর একটু দুর্বল হয়ে পড়ি। দশ নাম্বার গোল চত্বর গেলে আরেকবার (গুলি) খাই বুকে। সেগুলো বুকে লাগার পর যখন আবার একটু দুর্বল অনুভব করি, তখন বুঝি নাই যে আমার শরীরের ক্ষতি হচ্ছে বা (গুলি) আমার ভিতরে ঢুকতেছে। তখন শুধু বুঝতে পারছিলাম যে, ইটের কঙ্কর গালে লাগলে যেমন, ঠিক ওইরকম একটা অনুভুতি হচ্ছে। আমার শরীরে কিছু একটা ঢুকছে, কিন্তু আমার সেরকম কোনো ক্ষতি হচ্ছে না বা রক্ত বের হচ্ছে না বা দেখছি না। কারণ, আমি আন্দোলনের দিকে মুখ করে ছিলাম। যখন ঘুরে আবার থানার সামনের মোড়ে একেবারে পুলিশের সামনে গেলাম, তখন চোখে লাগে একটা (গুলি)। পুলিশ ওই মোড় থেকে এই মোড়ে আমার পিছু নিয়ে আমারে টার্গেট করে গান লোড করে গুলি করে। তখন আমার চোখে লাগে। দুইটা (গুলি) পড়ে আমার চোখে। দুইটা লাগার পর আমি সাথে সাথে পড়ে যাই। আমারে আজমল হসপিটালে নেয়। আজমল হসপিটালে একটা (গুলি) বের করা হয়। বের করে আমারে একটি ইমার্জেন্সি হসপিটালে পাঠাইয়া দেয়।

ষোলো: ১৭ তারিখে আপনি ঠিক কী কারণে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন?

আরমান: জালিম আওয়ামী লীগ সরকার যেসব কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিল, সেগুলো আমার একদমই পছন্দ ছিল না। যদিও আমার ফ্যামিলির কেউ কখনো আওয়ামী লীগ বা বিএনপি করে নাই যে ওদের বিপক্ষে বা শত্রু হয়ে থাকব। কিন্তু ১৫/১৬ তারিখের দিকে যে অবস্থা তৈরি হয়েছিল, আমি দেখলাম আমার একজন স্টুডেন্ট ভাইরে মারছে। আমিও একজন স্টুডেন্ট। ভাইবোনদের মেরে রক্তাক্ত করে ফেলছে, আবু সাঈদ মারা গেল। এইসব দেখে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। এরপর জানালা দিয়ে গুলি করে একটা বাচ্চা মেরে ফেলল। এসব দেখে মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল, চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। তখন নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে আন্দোলনে চলে গেছি।

ষোলো: ১৬ তারিখ আবু সাইদ শহীদ হলো রংপুরে, ১৬-১৭ তারিখ বিভিন্ন জায়গায় আরও অনেকেই শহীদ হয়েছে। আপনিও তো মারা যেতে পারতেন। আহত তো হয়েছেন, আরও বড় ইঞ্জুরি হতে পারত আপনার। তারপরও যাওয়ার সাহস কীভাবে পেলেন?

আরমান: আমি আসলে সাহস পেয়েছি আন্দোলন থেকেই। আমার চারপাশে দেখছি বিভিন্ন স্কুল (শিক্ষার্থী) যাচ্ছে, আমি চিন্তা করছিলাম সেখানে আমি গেলেও তো আরেকটু ভালো হবে বা আমি যদি আরও কয়েকজন নিয়ে যাই, তাহলে তাদের আরেকটু সহজ করে নিতে পারব। আর জেলের কথা বললে, আমি নিজেই জেল খাটছি। গুলি খাওয়া অবস্থায় আমি নিজেও জেলে ছিলাম।

ষোলো: আপনি (আন্দোলনে) খুব দ্রুতই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বললেন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর কি আপনি আর আন্দোলনে যেতে পেরেছিলেন?

আরমান: ১৮ তারিখে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে আজমল থাইকা আমারে সন্ধ্যা বেলায় ছাইড়া দেয়। উনারা বলছে ইমার্জেন্সি অন্য একটা চক্ষু হসপিটালে গিয়া চোখ দেখাইতে। চোখ ড্যামেজ হইয়া যাইতাছে। তো ১৯ তারিখ শুক্রবার ছিল। ওইদিন আমি তো বাইর হইতে পারতাছি না। বাইর হইলেই পুলিশ ফায়ার করে। আমার বাসা মিরপুর ১০-এ বেনারশিতে ছিল। সেখানে মানুষজন জুমার নামাজ পইড়া বাইর হইছে, আর পুলিশ সবাইকে ফায়ার করা শুরু করছে, রাস্তায় কাউরে নামতে দেয় নাই। গাজীপুর থাইকা আমার এক কাজিন আসছিল। কাজিনের সাথে আমি ভিতর দিয়া দিয়াবাড়ি হইয়া, হাউজবিল্ডিং হইয়া তারপর গাজীপুর গেছি। তো, যাওয়ার সময় বিকাল বেলা যখন হাউজবিল্ডিং-এ ছিলাম, তখন কিছুক্ষণ আন্দোলনে ছিলাম। একটু আহত ছিলাম, অসুস্থ ছিলাম। কিন্তু আন্দোলন বলতে ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়া ছিলাম। কারণ, গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীরের পিএসরে মাইরা লটকাইয়া ফেলছিল। ওটা তো অবশ্যই আপনি জানেন। মাইরা যে লটকাইয়া ফেলছিল। ওই ঘটনা আমার সামনেই হইছে। আমি তখন ওইখানেই ছিলাম। আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টার মতো ছিলাম। এরপর অস্বস্তি বোধ করতেছিলাম, তাই পরে আবার চলে গেছি।

ষোলো: মিরপুর-১০-এ আপনি পরে আরও যুক্ত হয়েছিলেন কি? ৫ আগস্টে কিংবা এর আগে?

আরমান: না, একচুয়ালি আমি ২০ তারিখে যখন গাজীপুর যাই, কয়েকটা মেডিকেলে যাই। যাওয়ার পর ২১ তারিখে করমতলি মেডিকেল হসপিটাল থাইকা একজন ডাক্তার, আগারগাঁওয়ের চক্ষু হসপিটালে আমারে চক্ষু অপারেশনের জন্য পাঠায়। আমার সাথে আরও দুই-একজন সহযোদ্ধা ছিল। অপারেশনের প্রস্তুতি নিয়া এম্বুলেসে আসার সময় উত্তরা আজমপুর ওভারব্রিজটায় যখন নামছি, তখন সেনাবাহিনী আটকায়। সেনাবাহিনী আটকায়া ছাইড়া দেয়। যখন পুলিশ স্টেশনের সামনে গেলাম, তখন কয়েকটা কনস্টেবল আইসা গাড়ি থামায়। গাড়ি থামায়া আমাগর গায়ে, বিশেষ করে আমার মুখে স্পট, গুলির দাগ—ওরা তো বুঝে শটগানের গুলি কোনটা— দেখেন আমারে ডাইরেক্ট বলতেছিল যে, ‘এ তো ফাইটার, স্যার’। জোরে একটা চিল্লানি দিছিল। আমাগর ভাগ্য খারাপ ছিল। পুলিশের এসেম্বলি চলতেছিল তখন। এসেম্বলি চলাকালীন ২০/৩০টা পুলিশ ছিল ওখানে। ওরা আইসা আমাগর এম্বুলেন্স ঘেরাও দিয়া ফেলছে। ঘেরাও দিয়া—আমার কাজিন ছিল ২জন—অগর দাড়ি ছিল, সবাইরে জঙ্গি বইলা, আমারে ফাইটার কইয়া লাত্থি মাইরা হাজতে ঢুকাইয়া দিছে।

ষোলো: এটা কোন থানা ছিল?

আরমান: উত্তরা পূর্ব থানা। ওখানে নেওয়ার পরে একদিন ওখানে রাইখা দিছিল… পরেরদিন ভোরে আমাদেরকে কোর্টে নিয়া যায়। কোর্ট থাইকা কোনো শুনানী ছাড়াই আমায় ডাইরেক্ট পাঠাইয়া দেয় কেরানীগঞ্জ জেলে।

ষোলো: কেরানীগঞ্জে কয়দিন থাকতে হয়েছিল?

আরমান: কেরানীগঞ্জে আমি প্রথম যেদিন ঢুকি, ওইদিন তো ডাইরেক্ট হসপিটালে নিয়া যায়। আমি অসুস্থ ছিলাম। চোখে গুলি। আর আমার সাথে যে আরও দুইজন আহত সহযোদ্ধা ছিল, তাদেরও চোখে স্পিং (পিলেট) ছিল। তো, ওখানে কোনো ট্রিটমেন্ট নাই। ব্যথার যন্ত্রণায় জ্বর ওইঠা যাইতো। ওরা আইসা একটা ইনজেকশন মাইরা দিত ব্যথার। পরে ওখানে যে ডাক্তার ছিল, ওনারাও একটু হেল্প করছিল। ওনারা বলছিল যে, তোমরা তো আমাদের ছেলের মতোই, দেখি তোমাদের জন্য বাইরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারি কিনা দ্রুত… 

ষোলো: আপনারা কেরানীগঞ্জ কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছিলেন কত তারিখে?

আরমান: মুক্তি বলতে, প্রায় ৮/৯ বা ১০ দিনের মতো ওখানে ছিলাম। ওখানে কোনো ট্রিটমেন্ট হয় না, কিছু না। লাস্ট মুহূর্তে আমাদের চোখ বাদ (নষ্ট) হয়ে যাইতেছিল। চোখ দিয়া পানি পড়া শুরু হইছে। তখন ডাক্তারটা উনার উপরে (পর্যায়ে) রিকুয়েস্ট করছে যে, এই তিনটা ছেলের অলরেডি চোঁখ ড্যামেজ হইয়া যাইতেছে। চিকিৎসা না হইলে পুরাই দেখবে না আর। লাস্ট মুহূর্তে উপর থেকে নির্দেশ আসছিল। শেখ হাসিনা প্রথমে আমাদেরকে না কইরা দিছিল।

প্রথমে একবার আমাদেরকে নেওয়ার কথা ছিল। পরে আবার না কইরা দিছে উপর থাইকা। শেখ হাসিনা বলছে। জেলার, সুপারেরও কিছু করার নাই। পরে ৫ তারিখে আমাদেরকে বাইরে নেয়। সেদিনই আমাদের তিনজনকে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান (ইন্সটিটিউট)-এ নেয়। কারাবন্দী অবস্থায়, পায়ে বেড়ি, হাতে হ্যান্ডকাফ লাগাইয়া চক্ষু বিজ্ঞানে নেয়। আলহামদুলিল্লাহ, ওখান থেকে চিকিৎসা নেওয়ার কারণে আমি কিছুটা দেখতে পাই। কিন্তু আমার সহযোদ্ধা যে দুইজন আছে, ওই দুইজনের চোঁখ ড্যামেজ হইয়া যায়। 

তো, ওখানে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞানের পাশেই তো গণভবন। ওখান থেকে শুনতে পাই যে, শেখ হাসিনা গেছেগা। এর পরেরদিনই আমার জামিন হয়। জামিন বলতে, কোনো স্বাক্ষর-টাক্ষর কিছুই হয় নাই। শুধু ভিডিও কলে আমাকে দেখছিল। ওখানে দেখেই ছাইড়া দিছিল।

ষোলো: তার মানে আপনি হসপিটাল থেকে ৬ আগস্ট ছাড়া পান?

আরমান: হ্যাঁ, ৬ তারিখে।

ষোলো: বাংলাদেশকে কেমন দেশ হিসেবে দেখতে চান?

আরমান: আমি চাই, এটা একটা ইসলামিক রাষ্ট্র হোক। কুরআন-হাদীসের আলোকে এই রাষ্ট্র শাসিত হবে। এবং এই রাষ্ট্রের সবাই যেন মাথা উঁচু করে চলতে পারে… এক কথায়, দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে। সবাই সবার হক বুঝে পায়। কারও উপর যেন জুলুম না হয়, এরকম বাংলাদেশ দেখতে চাই।

ষোলো: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।

আরমান: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।