ধরো, তুমি তোমার বন্ধুর সাথে ফোনে কথা বলছো। কথায় কথায় তোমার বন্ধু জিজ্ঞেস করল, ‘আজকে কী বার রে?’ তুমি ফোনের ক্যালেন্ডার থেকে দ্রুত দেখে নিয়ে বললে সোমবার। কিন্তু তোমাকে অবাক করে দিয়ে তোমার বন্ধু বলল মঙ্গলবার। তুমি ভাবলে ও হয়তো ঠাট্টা করছে। কিন্তু তোমার বন্ধু হলফ করে বলল ওদের ওখানে আজ মঙ্গলবার। তোমাদের দুজনের বাসা তো কাছাকাছি। একদিন সময়ের পার্থক্য হওয়ার প্রশ্নই আসে না। এমন কি কখনো হয় নাকি? একটি জায়গায় দুটো ভিন্ন দিন একসাথে কীভাবে সম্ভব?

ব্যাপারটা সাইন্স ফিকশনের মতো শোনালেও বাস্তবে আসলেই এমনটা সম্ভব! কীভাবে? এই ব্যাপারটি বোঝার জন্য আগে আমাদের গৎবাঁধা কেতাবি কিছু জিনিসপত্র জানতে হবে। চলো তাহলে, শুরু করি।

পৃথিবী ২৪ ঘণ্টায় নিজের অক্ষের ওপর ৩৬০ ডিগ্রি কোণে ঘুরে। অর্থাৎ, একবার পাক খায়। এ কারণে দিন-রাত হয়, একে বলে পৃথিবীর আহ্নিক গতি। সময় পরিমাপের জন্য পৃথিবীকে কিছু কাল্পনিক রেখা দ্বারা উত্তর-দক্ষিণ মেরু বরাবর ২৪ ভাগে ভাগ করা হয়, এই রেখাগুলোকে বলা হয় দ্রাঘিমা রেখা। প্রতি ভাগে গড়ে পড়ছে (৩৬০÷২৪) = ১৫ ডিগ্রি করে। এই অঞ্চলগুলোকে বলে “সময়-অঞ্চল” বা Time Zone এবং ১৫ ডিগ্রি দ্রাঘিমাজুড়ে এরা প্রত্যেকে বিস্তৃত। এর শুরু ধরা হয় ইংল্যান্ডের শহর গ্রিনিচকে, যাকে প্রাইম মেরিডিয়ান বা শূন্য দ্রাঘিমা বলা হয়। গ্রিনিচকে শূন্য ডিগ্রি (০°) দ্রাঘিমা ধরে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিকে ১৫°, ৩০°, ৪৫°… এভাবে ১৮০° পর্যন্ত রেখা হিসেব করা হয়। খেয়াল করে দেখো, ১৮০° পূর্ব এবং ১৮০° পশ্চিম দ্রাঘিমা রেখা কিন্তু একই রেখা!

সব তো বুঝলাম, কিন্তু দুটো তারিখ একই দিনে কীভাবে সম্ভব, এটা তো মিলাতে পারছি না। তাই তো?

আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা প্রশান্ত মহাসাগরের ১৮০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে অবস্থান করে। এটি হচ্ছে এমন একটি রেখা, যা সময়সীমা নির্ধারণ করে। অর্থাৎ, এই রেখা ক্যালেন্ডারের একটি দিনকে অন্য দিন থেকে আলাদা করে। তুমি যদি পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে এই রেখা পার হও, তাহলে একদিন তুমি “পাবে” বা gain করবে বা যোগ করবে। আবার যদি পশ্চিম থেকে পূর্বে যাও তাহলে একদিন “হারাবে” বা  lose করবে বা বিয়োগ করবে। আরেকটু সহজভাবে বলা যায়, এই রেখার পশ্চিমে যদি রাত ১১.৫৯ সোমবার হয়, তবে পূর্বে ইতোমধ্যেই মঙ্গলবার রাত ১২.৫৯ হবে। আন্তর্জাতিক তারিখ রেখার আশেপাশের দ্বীপগুলোতে প্রায়ই এমনটা হয়। কাছাকাছি বা পাশাপাশি অঞ্চলে সম্পূর্ণ দুটো ভিন্ন দিন, ভিন্ন তারিখ হয়!

তুমি জেনে হয়তো অবাক হবে (হুহ, সত্যিই অবাক হবে!) প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ কিরিবাতি পুরো দেশকে একই সময়ে রাখতে ১৯৯৫ সালে তাদের অঞ্চল সম্প্রসারণ করে। এতে তারা আন্তর্জাতিক তারিখ রেখার সম্পূর্ণ পূর্বে চলে যায়। এ-কারণে একদম পাশাপাশি অবস্থিত কিরিবাতি এবং সামোয়া দ্বীপের মধ্যে গোটা একদিনের পার্থক্য তৈরি হয়।

বেরিং স্ট্রেইটের ডিওমিড দ্বীপপুঞ্জের ছোট অংশটি যুক্তরাষ্ট্রের সময় মেনে চলে। আর বড় অংশটি রাশিয়ার অংশ, তাই রাশিয়ার সময় মেনে চলে। দ্বীপ দু’টি মাত্র ১.২ মাইল দূরত্বে অবস্থিত অথচ ওদের সময়ের পার্থক্য ২১ ঘণ্টা! বড় ডিওমিডকে ডাকা হয় আগামীকাল দ্বীপ (Tomorrow Island), আর ছোট ডিওমিডকে ডাকা হয় গতকাল দ্বীপ (Yesterday Island)। তুমি যদি এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপের দিকে তাকাও, তাহলে বলতে পারো তুমি আদতেই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছো!

আমরা মনে করি, সময় একদম নির্দিষ্ট, ফিজিক্স পড়ে পাই-টু-পাই হিসেব করে বুঝি সব বের করে ফেলতে পারব। সময়ের হিসাব আসলে খুবই নমনীয় মানব আবিষ্কারগুলোর একটি। ভেবে দেখো, খুব সুন্দর একটি বিমানে, প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো একটা দ্বীপে তুমি গিয়েছ। একই দিনে দিনটি “আজ” হতে পারে, আবার “কাল”ও হতে পারে! চতুর্থ ডাইমেনশন হিসেবে পরিচিত “সময়” খুব রহস্যময় একটি ডাইমেনশন। আমরা যত জানি, তত জাদুকরী লাগে, তাই না?