তখন হবে সন্ধ্যা সাতটা। শীতের সময়। আযান, নামায আগেভাগেই হয়ে গেছে। নামায পড়ে বই নিয়ে বসলাম। পর্যায় সারণীর প্রথম বিশটি মৌলের নাম কিছুতেই মনে রাখতে পারছি না। আজ দিয়ে তিন দিন যাবৎ ওই একটা জিনিসই শুধু পড়ছি।
হঠাৎ মাইগ্রেনের ব্যাথা শুরু হলো। আম্মুকে বললাম একটু চা দিতে। আম্মু হঠাৎ আমার ওপর ক্ষেপে গিয়ে বলল, ‘তোর ভাইকে পাচ্ছি না। আর তোর এখন চা লাগবে!’
কথাটা শুনে চমকে গেলাম। বিকালেই তো রাহাত (আমার ভাই) নাচতে নাচতে আব্বুর সাথে মেলায় গেল। আম্মুকে আব্বুর কথা জিজ্ঞেস করতেই বলল, আব্বু মেলাতেই ওকে খুঁজছে। মামাও তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল।
বাড়িতে আম্মু কান্নাকাটি শুরু করেছে। এদিকে টেনশনে আমার মাইগ্রেনের ব্যাথা আরও বেড়ে গেল। মাথাটা যেন ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে। খোঁজাখুঁজি কতদূর জানতে আব্বুকে ফোন দেব ভাবছি, এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠল। আম্মু হম্বিতম্বি করে দরজা খুলতে গেল। এ ঘর থেকে রাহাতের কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে নিশ্চিত হলাম ওকে পাওয়া গেছে।
গিয়ে দেখি আব্বু ওকে মারছে। আম্মু আর মামা ওকে আগলানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওর দোষ হলো ক্লাস ফোরে পড়েও কেন আব্বু-আম্মু কারোরই ফোন নাম্বার মনে রাখতে পারে না। আবহাওয়ার করুণ অবস্থা দেখে বুঝলাম—যদি এক্ষুনি গিয়ে পড়তে না বসি, তাহলে বকাবকির তির তীব্র বেগে আমার দিকে ছুটে আসবে।
কিছুক্ষণ পরই আব্বু ঠান্ডা হয়ে গেল। আম্মু ছেলেকে আদর করতে ব্যস্ত। এবার আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো—ওকে যেন আব্বু-আম্মুর ফোন নাম্বার মুখস্থ করাই।
রাতে খাওয়ার পর ওকে নিয়ে আমার ঘরে আসলাম। নাম্বারগুলো বলা শুরু করব এমন সময় ওর গলার কাতর সুর, ‘আপু, আমি মনে রাখতে পারি না। অনেক চেষ্টা করি, তাও পারি না।’
মেজাজটা অনেক গরম হলেও মনে হলো রাহাত কথাটা ভুল বলেনি। আমিও যে ভুলে যাই না ব্যাপারটা এমন না। কী করা যায়, কী করা যায়… আইডিয়া!
গুগলে সার্চ দিলাম, ‘তথ্য মনে রাখার সহজ উপায়’। একটা লেখার ওপর নজর যেতেই পড়া শুরু করলাম।
‘প্রতিদিন আমরা অনেক তথ্যের সাথে পরিচিত হই। কখনো সেটা হয় অনেক মজার। আবার কখনো বিরক্তিকর। আমরা সচরাচর যে তথ্যগুলো জানতে পারি বা শিখি তা মনে রাখার চেষ্টা করি। আমাদের প্রয়োজনেও আমরা তথ্য মনে রাখি। দৈনন্দিন হাজার হাজার তথ্যের সাথে পরিচিত হতে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ তথ্যই আমরা ভুলে যাই। প্রয়োজনের সময় সঠিক তথ্যগুলো আর মনে পড়ে না। আমরা সব তথ্য একসাথে গুলিয়ে ফেলি। তাই আমাদের শেখা আর জানা জিনিসগুলো মনে রাখার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, যেন আমরা যা শিখি সহজেই তা ভুলে না যাই।
তুমি যদি তোমার শেখা বা জানা তথ্যগুলোর একটা অংশ ধরে রাখতে চাও, তবে তোমাকে বারবার তথ্যগুলো মনে করে সেগুলো ঝালিয়ে নিতে হবে। নয়তো সহজেই ভুলে যাবে। তোমাকে নিশ্চিত করতে হবে যে, তুমি বারবার তথ্যটির কথা স্মরণ করছ কি না। গরুর জাবর কাটা দেখেছ না? অনেকটা সেভাবে তোমাকে জাবর কাটতে হবে। তো, পুরো ব্যাপারটা কেমন হবে চলো ধাপে ধাপে দেখি—
১. তোমার শেখা নতুন তথ্যগুলো কোথাও লিখে ফেলো।
২. পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুমি যা লিখলে তা পুনরায় পড়ো। শুধু পড়লেই হবে না। যা লিখেছ সেটা নিয়ে একটু চিন্তা করো। না দেখে মনে করার চেষ্টা করো কী কী পড়েছ।
৩. তুমি যা যা লিখেছ, তা সাধারণ ফ্ল্যাশকার্ডে (স্টিকি নোট ব্যবহার করতে পারো বা কাগজ ছোট করে কেটে বানাতে পারো) পরিণত করো। অর্থাৎ ছোট ছোট কাগজে বা কার্ডে একটা একটা করে তথ্য লিখে রাখো। [ধরো, রাহাত আম্মুর আর আব্বুর ফোন নাম্বার মুখস্ত করবে। সে একটা কার্ডে আম্মুর ফোন নম্বর লিখল, আরেকটিতে আব্বুর।]
৪. একদিন পর, পরীক্ষা করো তুমি তোমার ফ্ল্যাশকার্ডগুলো ব্যবহার করে কতটা ভালোভাবে তথ্যগুলো মনে করতে পারছ। এটা নিয়মিত করো। বিশেষ করে, তুমি যখন তোমার দৈনন্দিন কাজগুলো করছ।
ট্যাপ ছেড়ে বালতিতে পানি ভরার জন্য অপেক্ষা করছ? একবার তথ্যগুলো স্মরণ করো। স্কুলের জন্য হাঁটছ? পকেট থেকে কার্ড বের করে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নাও। খেলতে মাঠে যাচ্ছ? তথ্যগুলো আবারও মনে করার চেষ্টা করো।
যে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে তোমার বারবার সমস্যা হচ্ছে সেগুলোর আরেকটা নোট তৈরি করো। সেগুলোর প্রতি বিশেষ নজর দাও। তুমি বিষয়গুলো এখনো বুঝে উঠতে পারোনি। হয়তো তাই এই তথ্যগুলো মনে রাখতে পারছ না। এক্ষেত্রে তোমার শিক্ষক বা সহপাঠীর সাহায্য নিয়ে বিষয়টি ভালোমতো বুঝে নাও।
৫. এক সপ্তাহ পর তোমার করা প্রথম নোটটা খুলো। আবার পড়ো। কীভাবে আবার পড়বে?
শেখা তথ্য আবার শেখার জন্য তথ্যগুলো না দেখে লিখো। যদি সব লিখতে পারো, তাহলে তো হয়েই গেল। আর না হলে আবার ১ নম্বর ধাপ থেকে শুরু করো।’
আমি এ সবকিছু রাহাতকে পড়ে শুনালাম। আর ওকে এই অনুযায়ী কাজ করতে বললাম। ওর উত্তেজনা দেখে মনে হলো, কতই-না মনে রাখতে পারবে! যদিও আমি জানি ওর পক্ষে শুধু আদর্শলিপির ওই ১, ২ আর অ আ-ই শুধু মনে রাখা সম্ভব।
একটা কাগজে ওকে নাম্বার দুইটা লিখে দিলাম।
দুই সপ্তাহ পর আব্বু আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, ওর উন্নতি কেমন। আমি কেবলই বলতে যাব ওকে দিয়ে হবে না, রাহাত এসে দুটো নম্বরই গড়গড় করে বলে দিল। তখন আব্বুর থেকে বাহবা পাওয়ার জন্য আমিও হাসি হাসি মুখ করে থাকলাম… যেন আমি আগে থেকেই জানতাম যে, ও সব পারবে! তবে পরে ওকে ডেকে বললাম, কী করে করলিরে মুখস্থ?
ও আমার ফোন থেকে মনে রাখার ওই ধাপগুলো বের করল। আর ওর বানানো নোট, ফ্ল্যাশকার্ড, খাতা সব এনে আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘এইভাবে’।
ওর ওপর প্রক্রিয়াটার প্রভাব দেখে আমি নিজেও সেটা করা শুরু করলাম।
কয়েকদিন পর মৌখিক পরীক্ষা ছিল শফিক স্যারের। স্যার খুব রাগী মানুষ। দেখলেই ভয়ে হাত-পা জমে যায়। স্যার আমাকে পর্যায় সারণীর প্রথম ১০টা মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা বলতে বললেন। আমি সুন্দর করে সব বলে দিলাম! স্যার বেশ প্রশংসা করলেন। হাসি আমার দু’ কানে গিয়ে ঠেকল। টিফিনের জন্য আব্বু যে টাকা দিয়েছিল, সেখান থেকে রাহাতের জন্য একটা মাল্টা কিনলাম। মাল্টা ওর খুব পছন্দ। হাজার হোক সে মেলাতে হারিয়ে গিয়েছিল বলেই তো আমার এই মনে না থাকার সমস্যা দূর হলো!