সঠিক ইতিহাসের গুরুত্ব সত্যিই অপরিসীম। ইতিহাস বিকৃত করে, মগজধোলাই করে, ইতিহাসের এক পিঠ দেখিয়ে অপর পিঠ গোপন করে আওয়ামী জাহিলি সরকার এক যুগেরও অধিক সময় ধরে নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছে। যার চরমরূপ ধারণ করে ২০২৪ এর জুলাইয়ে। নির্বিচারে, নির্দ্বিধায় মাত্র ২০ দিনে হাজার হাজার নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে খুন করে তারা।
জুলাই অভ্যুত্থানকে বিকৃত করে এক শ্রেণির সুবিধাবাদী ফায়দা লুটে নিতে চাচ্ছে। হাসিনা না পালালে বর্তমানে যারা আমাদের দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দিত। জুলাই গণহত্যার খুনিদের বাঁচানোর, পুনর্বাসনের সম্মিলিত চেষ্টা চালাচ্ছে। ছাত্র-জনতাকে ভিলেন বানাতে চাচ্ছে। অতি উদারতা দেখিয়ে কোনো কোনো নেতা তাদের ক্ষমা করে দেবার কথা বলছেন।
আমরা এই লেখায় জুলাই গণহত্যার সময়কার কিছু বীভৎস, হৃদয় বিদারক ঘটনা তোমাদের আবারও মনে করিয়ে দেবো। সব সময় যেন আমাদের মনে পড়ে কীভাবে তাঁরা প্রাণ সঁপে দিয়েছিল। জল্লাদদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আমরা যেন আবারও গর্জে উঠতে পারি। আমরা কখনো যেন ভুলে না যাই আমাদের আসল সুপারহিরোদের। যাদের বিরুদ্ধে এই নিদারুণ ত্যাগ তাদেরকে আবারও ক্ষমতায় না বসায়, দু-একটা মিষ্টি কথার জেরে।
১। ১৮ জুলাই, নরসিংদী জেলখানার মোড়
১৫ বছর বয়সী তাহমিদ গুলিবিদ্ধ হয়। হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করে। স্ট্রেচারে করে তাহমিদের লাশ নিয়ে ফেরার পথে পুলিশ ছাত্র-জনতাকে বাধা দেয়। ব্যাপক গুলি চালায়। অসংখ্য গুলি চালায় তাহমিদের নিথর দেহে, তাহমিদের বাবার সামনেই। এই হৃদয় বিদারক ভিডিও নিশ্চয়ই তোমরা অনেকেই দেখেছ।
২। ১৮ জুলাই, সাভার
জড়বস্তুর মতো গুলিবিদ্ধ ইয়ামিনকে পুলিশের সাঁজোয়া এপিসি গাড়ির উপর থেকে ফেলে দেয় রাস্তায়। টেনে হেঁচড়ে জীবিত ইয়ামিনের নিস্তেজ দেহকে ডিভাইডার পার করিয়ে সার্ভিস লেনে ছুঁড়ে ফেলে দেয় পুলিশ। জুলাই গণহত্যার অন্যতম অমানবিক দৃশ্য ছিল এটি। সেদিন ইয়ামিন রোজা রেখেছিল। অসংখ্য রাবার বুলেটে শহীদ হন এমআইএসটির চতুর্থ বর্ষের ছাত্র শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন। সেদিনই ছিল ইয়ামিনের পরিবারের সাথে শেষ দেখা। বাবার সাথে শেষ মসজিদে যাওয়া।
৩। ২০ শে জুলাই। রাস্তায় পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ এক ব্যক্তিকে একাই হাসপাতালে নিয়ে যায় ষোলো বছরের ইফাত হাসান। এই মানবিক কাজের অপরাধে পুলিশ পিতৃহীন ইফাতকে হাসপাতাল থেকে বের করে বুকের বাঁ পাশে গুলি করে। পুলিশকে আঙ্কেল ডেকে, এই এলাকায় আর না আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েও মন গলেনি। ইফাতের চার বছরের বোনের, ভাইয়ের সাথে মধুর শৈশব থেমে যায়। দু'বছরের ব্যবধানে স্বামী, ছেলেকে হারিয়ে ফেলেন ইফাতের মা।
৪। আরেক ষোলো আমিনুল ইসলাম। ছোটবেলায় মাদরাসায় পড়ত। পরবর্তীতে পড়া বন্ধ করে কারখানায় কাজ নেয়। বেতন পুরোটা পরিবারকে দিত। ওর স্বপ্ন ছিল ফুটবলার হবার। ২১ জুলাই কাজলা এলাকায় আমিনের রিক্সাচালক বাবাকে দুই ব্যক্তি এসে বলে, এক গুলিবিদ্ধ কিশোরকে হাসপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালে নেবার পরে রিকশাচালক দেখেন এ তারই ছেলে আমিন!
৫। আশুলিয়া বাইপাইলে ৫ আগস্ট ঘটে সবচেয়ে নির্মম ঘটনা। থানা রোডের গলিতে ৭ জন গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থীর পড়ে থাকা দেহ ভ্যানে স্তুপ করে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে একটি পিকআপ ভ্যানে ঢুকিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় । তারা সকলে মৃত ছিল নাকি জীবিত না জেনেই! কয়েকঘণ্টার ব্যবধানে বাইপাইলে ৩১ জনের মৃত্যু ঘটে পুলিশের গুলিতে। পরদিন গুলিবিদ্ধ আরও ১৫ জন মারা যায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি দেড় হাজারের বেশি মানুষ। চিন্তা করো, কতগুলো পরিবার বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে!
আজ যারা জাতির সাথে গাদ্দারি করছে, শহীদদের পরিবার-পরিজনদের মনের বেদনা কি একবারও উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে তারা! তারা ছিল কারও বিকেলে আড্ডা দেওয়া, একসাথে খেলা, ঘুরতে যাওয়া, একাকিত্বে সঙ্গ দেওয়া বিশ্বস্ত বন্ধু। তারা ছিল কারও ভাই, যেকোনো সমস্যায় বলত, ‘চিন্তা করিস না, আমি দেখছি।’ বোনের মন খারাপ ভালো করে দিত নিমিষেই। হাসিমুখে পূরণ করত কত আবদার। তারাও ছিল কারও সন্তান। মা-বাবার চোখের মণি, শেষ বয়সের আশ্রয়।
খুনি হাসিনার পতনে শহীদদের অবদান সবচেয়ে বেশি। দেশকে নতুন করে গড়তে সবার আগে ভাবা উচিত, যারা প্রাণ বিলিয়ে দিল, কেমন বাংলাদেশ গড়তে তারা রক্ত দিয়েছে। অথচ আজ তাদের রক্তের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে।
এই হাজার হাজার খুনের খুনির বিচার কবে শুরু হবে? নাকি হাজার হাজার মানুষ খুন ও হাজারো পরিবারকে বিধ্বস্ত করা ফিরআউনের দল পার পেয়ে যাবে! কে নেবে শহীদ ও আহত পরিবারের মানুষদের দায়িত্ব?