সবকিছু তো ঠিকঠাকই যাচ্ছিল। ইয়ে মানে, ঠিকঠাক দেখানো হচ্ছিল আরকি। জনপ্রিয় ইংরেজ সাহিত্যিক জর্জ অরওয়েল তার বিখ্যাত উপন্যাস 1984-তে বলেছিলেন, “যুদ্ধই শান্তি, পরাধীনতাই স্বাধীনতা আর অজ্ঞতাই শক্তি”। কী? অবিশ্বাস্য লাগছে না? হ্যাঁ, ঠিক যেন এই শব্দগুলোকেই সাপের বিষের মতো ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছিল মানবমস্তিষ্কে। চারদিকে চলছিল কেবল উন্নয়নের গুণগান। প্রতিনিয়ত দেখানো হচ্ছিল দেশের অর্থনীতি আগের চেয়ে কত্ত বেশি চাঙ্গা হয়েছে৷ জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে আর হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে রোজ দু’বেলা মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আর আন্ডারপাসের সবক না দিলে যেন চলতই না তাদের। ইশ! বোকারা এতটুকুও বুঝত না সরকার তাদের জন্য কত কী-ই না করেছে, করছে!
নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিবর্জিত পাঠ্যপুস্তকের সমন্বয়ে এক জগাখিচুড়ি মার্কা শিক্ষাব্যবস্থা আর অপ-চিকিৎসার বলির পাঠা হয়ে চিৎকার করে কাতঁরাতে থাকা রোগীদের আর্তনাদ - এগুলোই ছিল তাদের উন্নয়নের গল্ল। আরও শুনবে? সড়কের তীব্র যানজটে পার হওয়া নিত্যদিনকার যান্ত্রিক জীবন, দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় চাপে নরক্লিষ্ট শহুরে মধ্যবিত্তের হাহুতাশ, হাসপাতালের বিছানায় সেবা না পাওয়া অসহায়দের দুর্দশা, জামিনে সাজা পাওয়া অপরাধীদের গলায় ঝুলতে থাকা ফুলের মালা আর নিরপরাধীদেরকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসির রায়; ও হ্যাঁ, সাথে গুম-খুন-ক্রসফায়ার তো আছেই, পাশাপাশি অসংখ্য মেধাবী তরুণের চাকরি না পাওয়ার আক্ষেপ, আর ইসলাম প্র্যাক্টিসিংদের ওপর চলা দমন-পীড়ন-নির্যাতন তো না হলেই না! এর সাথে চলছিল দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকা ফাঁকি দিয়ে বারো মাসের তেরো পার্বণে কোটি টাকা অপচয়ের এক রমরমা উৎসব আর ইতিহাস বিকৃত করে মুজিববাদের জয়গান। কী, আরও লাগবে উন্নয়ন?
বন্ধুরা, বলছিলাম খুনি হাসিনার গড়ে তোলা এক বিশাল জুলুমতান্ত্রিক রাজ্যের কথা, যার কারিগর ছিল তারই পিতা শেখ মুজিব। তাকেই বানানো হয়েছিল প্রজাদের খোদা, তার উপাসনা করতেই প্রজাদেরকে রীতিমতো বাধ্য করা হতো সেই রাজ্যে। নামে-বেনামে সেখানে ছিল অসংখ্য উজির। এরাই টিকিয়ে রেখেছিল খুনি হাসিনার মসনদকে। উন্নয়নের ভেলকিবাজি দেখিয়ে প্রজাদের রীতিমতো গোলাম বানিয়ে রাখা হতো সেখানে। কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয়নি সেই রাজ্য। প্রায় দেড়যুগের শাসনামলে সাধারণ মানুষের ওপর চালানো হাসিনার তান্ডব রূপ নিয়েছিল রক্তাক্ত জুলাইয়ে। মুহূর্তেই তাসের ঘরের মতো খসে পড়েছিল সেই রাজ্য। খুনি হাসিনা পালিয়েছে তো একবছর আগেই। তবে সেই উজিরগুলো কিন্তু এখনো রয়ে গেছে। কেউ আত্মগোপনে, কেউবা মুখোশ পাল্টে দিব্যি চলাফেরা করছে। কিন্তু কারা তারা? জানতে চাও? চলো, খুলেই বলি!
সেক্যুলার এলিট
হাসিনার ক্ষমতায় টিকে থাকার পেছনে একমাত্র দর্শন ছিল একাত্তরের চেতনা। এই চেতনার মাপকাঠি দিয়েই জনগণের এক অংশকে একাত্তরের পক্ষের এবং অপর অংশকে বিপক্ষের শক্তি হিসেবে ভাগ করত। যারা বিপক্ষের শক্তি ছিল, তাদেরকে সহজেই সে “জঙ্গি-রাজাকার” তকমা দিয়ে জেল ও আয়নাঘর ভর্তি করত। এসকল মাজলুমদের ওপর চালানো হতো নির্মম অত্যাচার। এই অত্যাচার দেখে হাসিনার জুলুমের বিরুদ্ধে কেউ ভয়েও মুখ খুলত না। সবাই মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকত। অথচ পুরো ঘটনাটাই ছিল বানানো এবং পরিকল্পিত নাটক। আর এই নাটকের পটভূমির কারিগর হলেন জাফর ইকবাল, আনিসুল হক, শাহরিয়ার কবির, নিঝুম মজুমদার গংরা। তোমরা নিশ্চয়ই তাদের নাম শুনে থাকবে। আমাদের সমাজে তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ হিসেবে। একাত্তরের বয়ান প্রচারের মাধ্যমে তারাই জুলুমবাজ হাসিনার সিংহাসনকে টিকিয়ে রেখেছিল। সেক্যুলার বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেই হাসিনা ‘হাসিনা’ হয়ে উঠেছিল। আর তার প্রতিটা কথায় ‘জি হুজুর’ বলে সমর্থন দিয়েছে এই এলিটরা। সেক্যুলারিজমকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে হাসিনা। জুলাই আন্দোলনে যখন সকল শিক্ষার্থীরা রাজাকার স্লোগান দেয়, তখন এই এলিটরাই সর্বপ্রথম আফসোস করতে করতে মুখোশ খুলে বেড়িয়ে আসে৷ কেননা এই শিক্ষার্থীরাই তাদের গড়া চেতনার ঢালকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে, তাদের স্বোপার্জিত ফসলগুলোতে পানি ঢেলে দিয়েছে।
মিডিয়া উইং
হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে অন্যায়ভাবে দেশকে শাসন করেছে৷ এবং তার এই প্রতিটি অন্যায়ের বৈধতা দিয়েছে দেশের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যম ও মিডিয়াগুলো। যেমন- ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, ৭১ টিভি, কালের কণ্ঠ ইত্যাদি। স্বৈরাচার হাসিনার ক্ষমতায় থাকাকালীন তারা সত্যকে মিথ্যা হিসেবে এবং মিথ্যাকে সত্য হিসেবে উপস্থাপন করে গেছে জনগণের কাছে। জঙ্গি নাটকের পশরা সাজিয়ে বসেছে। খুনি হাসিনার পাশবিক চেহারাকে লুকিয়ে রেখে তার মিথ্যা প্রতিচ্ছবি দেখিয়েছে সবার কাছে৷ এমনকি জুলাই আন্দোলনেও যখন নিরীহ শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণ চালানো হচ্ছিল, তখনো হাসিনার পক্ষেই তাবেদারি করে গেছে এসব মিথ্যা মিডিয়াগুলো। জুলাই আন্দোলনের পরবর্তী সময়েও তাদের কৃতকর্মের প্রতি ন্যুনতম অনুতাপ লক্ষ্য করা যায়নি; বরঞ্চ এখনো নির্লজ্জের মতো তারা আওয়ামী জাহিলিয়াতের আদর্শের পুনঃপ্রচার করে যাচ্ছে।
সেলিব্রেটি
সামান্য ফুরসত পেলে বিনোদন পাওয়ার তাড়নাটা কমবেশি সবারই আছে। আর এই বিনোদন দেওয়ার পেছনে নিয়োজিত একদল নীতিহীন সেলিব্রেটি অর্থের লোভ সামলাতে না পেরে পা মাড়িয়েছিল এক অন্ধকার চোরাবালিতে। সামান্য মূল্যেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল তারা হাসিনার কাছে। এদের মধ্যে রয়েছে নায়ক, গায়ক, শিল্পী, খেলোয়াড় ও টিভি পর্দার জনপ্রিয় তারকারা। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট টিমের অন্যতম দু’জন সাবেক খেলোয়াড় ছিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা ও সাকিব আল হাসান। সবার কাছেই একসময় বেশ জনপ্রিয় ছিলেন তারা৷ হয়তোবা এখনো আছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই চেহারা পালটে যেতে থাকে তাদের। আওয়ামীলীগের অসংখ্য প্রকাশ্য অপকর্মের সাক্ষী হওয়া সত্ত্বেও উভয়ই যোগ দেন হাসিনার দলে। নির্বাচনে নিজেদের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য ব্যবহার করেছেন তাদের সেলিব্রেটি ইমেজকে। অথচ জুলাই আন্দোলনের ক্রান্তিকালীন মুহূর্ত প্রত্যক্ষ করেও সম্পূর্ণ নিশ্চুপ ছিলেন তারা। একটিবারও শিক্ষার্থীদের সমর্থনে মুখ খুলে কোনো উচ্চবাচ্চ্য তো করেনইনি, বরঞ্চ শিক্ষার্থীদের কোনোপ্রকার সমর্থনও দেননি৷ যখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের শরীর রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছিল, সেই সময় তারা আনন্দ করছিলেন আর ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন পরিবারের সাথে। সাকিব আল হাসান তার ফেসবুকে স্টোরি দিচ্ছিলেন ভ্রমণের।
বহিঃশত্রু
এই অঞ্চলকে ঘিরে ভারতের কিছু সুনির্দিষ্ট স্বার্থ, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য আছে। বিভিন্ন নথিপত্র, বই ও গোপন চুক্তিতে এসব বিষয়গুলো উঠে এসেছে। বাংলাদেশ যেন কখনোই ভারতের জন্য হুমকি হয়ে না ওঠে, তাই ভারতের দরকার হাসিনার মতো পুতুল সরকার, যাদেরকে ইচ্ছেমতো নাচানো যাবে। তাই আওয়ামী সরকারের আমলে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি দিয়েই দেশ চালাতে হয়েছে হাসিনাকে। মুখে মুখে বন্ধুত্বের বুলি আওড়ালেও বাস্তবে ভারত সর্বদাই আমাদের সাথে শত্রুভাবাপন্ন আচরণ করেছে। কিছু উদাহরণ দেখা যাক—
ক) অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ: ভারত আমাদের দেশকে তার একটি করদ রাজ্য বানাবার সব ধরনের চেষ্টাই করেছে। বরাবরই জাতীয় নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী সরকারকে ভারত কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন জুগিয়ে এসেছে। আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় এসেই ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে পিলখানায় সামরিক অফিসারদের হত্যাকাণ্ড ঘটায়৷ সেনাবাহিনীকে হাসিনার অনুগত রাখার জন্যেই এমনটা করা হয়েছিল। তাছাড়া আমাদের সাথে বানিজ্যের ক্ষেত্রেও ভারত নিজ স্বার্থকেই সবার আগে রাখে।
খ) শাপলা আন্দোলন: ২০১৩ সালের ঘটনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কটুক্তিকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, তাঁর সম্মান রক্ষায় রাস্তায় নেমে আসে লাখো ইসলামপ্রিয় তাওহীদি জনতা৷ তাদের দাবি ছিল নবীজির অবমাননার বিরুদ্ধে সরকার যেন দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু তৎকালীন হাসিনা সরকার তার কোনো তোয়াক্কাই করেনি। উলটো রাতভর চালিয়েছে নির্মম ক্র্যাকডাউন। সে বছর ৫-ই মে রাতে বিদ্যুৎ বন্ধ করে সশস্ত্র বাহিনীকে রাস্তায় নামানো হয়েছিল। নিরীহ মুসলিমদের উপর হাসিনার হুকুমে ব্যবহৃত হয়েছিল প্রায় দেড়লক্ষ টিয়ারশেল, বুলেট, গ্রেনেড ও প্রাণঘাতী অস্ত্র৷ এ সবকিছুর পেছনেও আছে ভারতের দাদাবাবুদের কালোহাত।
গ) সীমান্তে আগ্রাসন: আমাদের দেশের সীমান্তে প্রবেশ করে প্রায়ই ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা অতর্কিত আক্রমণ চালায়। গুলি করে হত্যা করে নিরীহ গ্রামবাসীদেরকে, ধ্বংস করে দেয় অসংখ্য ক্ষেত-খামার ও ফসল। ২০১১ সালে ফেলানী হত্যাকাণ্ড ছিল এমনই একটি ঘটনা, যার বিচার আজও হয়নি। তাছাড়া সীমান্তে মাদক চোরাচালান, মানব পাচারসহ বহু মানবতাবিরোধী অপরাধেও ভারতের নাম যুক্ত। প্রতিবছর ভারত আমাদেরকে না জানিয়েই তাদের সীমান্তের বাঁধ (ড্যাম), ব্যারেজ, স্লুইস গেটগুলো খুলে দেয়। ফলশ্রুতিতে সেই পানি আমাদের দেশের নিম্নাঞ্চল দিয়ে প্লাবিত হয়ে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম বন্যার৷ এতে অসংখ্য বানভাসি মানুষকে ঘর-বাড়ি, গবাদি পশু, কৃষিজমি হারাতে হয়৷ দেশে তৈরি হয় এক বিরাট অর্থনৈতিক সংকট।
ঘ) জুলাই আন্দোলন: জুলাইয়েও হাসিনার প্রত্যক্ষ মদদে যে দেশটি এগিয়ে আসে, সেটি হলো ভারত। বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ পুলিশের ছদ্মবেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর গুলি চালিয়েছে। এমতাবস্থায় তাদের হিন্দিভাষায় কথাও বলতে দেখা গেছে। ভারত জুলাইয়ের পরেও নানাভাবে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চেয়েছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রসঙ্গে। এদেশে যদি সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়, তবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবার জন্য ভারতের জন্য সেটি খুব বড় একটি সুযোগ হবে। আর তাই এমন ঘটনাগুলোর অপেক্ষায় বসে থাকে তারা। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর দাবি হলো, ৫ আগস্টের পর এদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন বেড়ে গেছে। অথচ এসব ছিল ডাহা মিথ্যা কথা। হাসিনা পলায়ন করার পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু লোক মারা গেছে সত্য, তবে সেটা সাম্প্রদায়িক কারণে না। বিভিন্ন ফ্যাক্ট চেকিং রিপোর্টে উঠে এসেছে, এসব মৃত্যুর প্রধান কারণগুলো হলো জমিজমা-ঋণসংক্রান্ত বিরোধের কারণে নিহত হওয়া, শত্রুতার জের ধরে ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে হত্যা করা কিংবা শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগ কর্মীদের নিহত হওয়া। অর্থাৎ, এসবের কোনোটাই সাম্প্রদায়িক কারণে সৃষ্ট না।
তো বন্ধুরা, আমরা এতক্ষণ ধরে সেইসব উজিরদের প্রকৃত চেহারাকে তোমাদের সামনে তুলে ধরলাম৷ হাসিনা চলে গেছে, কিন্তু তার পোষা উজিরেরা এখনো রয়ে গেছে। হাসিনার মতোই বিকল্প কাউকে না কাউকে বসানোর জন্য এরা এখনো অপচেষ্টা এবং অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদেরকে তাদের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার এবং সচেতন থাকতে হবে। সচেতন করতে হবে অন্যদেরকেও।