জুলাই ২০২৪ এর এক তপ্ত দুপুর। ঢাকার আব্দুল্লাহপুর এলাকায় তখন আন্দোলনকারীরা রাস্তা দখলে রেখেছে। এই আন্দোলনের স্রোতে এক পা হারা পথশিশু রাকিবও সবার সাথে রাস্তায় নেমেছে। এক পা নিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আন্দোলনে শামিল হয়েছে। রাস্তায় পথচারীদের নিরাপদ রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছে সে, আবার অ্যাম্বুলেন্সকেও সে রাস্তা দেখাচ্ছে । তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো যে, এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও আন্দোলনে কেন আছে, সে মৃত্যুকে ভয় পায় কিনা। তখন সে দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর জানায় যে, মরতে সে ভয় পায় না।[১]
রাকিবের মতো এমন অনেক পথশিশু জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। যেমন, মিরপুর-১০ এ আন্দোলনে পথশিশুদের সরব অংশগ্রহণ ছিল, যা আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি। আন্দোলনকারীদের সাথে তাল মিলিয়ে তারা স্লোগান দিচ্ছিল, রাজপথ দখলে রাখতে সাহায্য করছিল। এভাবে জুলাই আন্দোলনে অনেকের মতো এই পথশিশুদেরও অবদান রয়েছে।
আবার একইভাবে বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষেরও অবদান রয়েছে এই আন্দোলনে। এদের মধ্যে যেমন রিকশাওয়ালা রয়েছেন, তেমনি আছেন সিএনজি চালক, মুদি দোকানদার, হকার—এমন শ্রমজীবী মানুষগণ।
তোমাদের মনে আছে কি, শহীদ নাফিজকে রিকশায় বহন করে নিয়ে যাওয়া সাহসী সেই রিকশাচালকের কথা? রক্তাক্ত নাফিজের দেহ বহনকারী সেই রিকশাচালকের নাম নুর মোহাম্মদ। রিকশায় ঝুলন্ত নাফিজের আহত দেহের সেই দৃশ্য ভুলার মতো না। জুলাইয়ের সেই ভয়াবহ দিনে পুলিশের গোলাগুলির মাঝেও নুর মোহাম্মদের একমাত্র চেষ্টা ছিল নাফিজকে হাসপাতালে নিয়ে যদি বাঁচানো যায়।[২]
১৯ জুলাই পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন রিকশাচালক ইসমাইল। সেদিন অন্যান্য রিকশাচালকদের মতো তিনিও আন্দোলনে ছিলেন।[৩] হাসপাতালের সিঁড়িতে পড়ে থাকা রিকশাচালক ইসমাইলের রক্তাক্ত নিথর দেহ আজও মনকে ব্যথিত করে।
আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হন রিকশাচালক সুফিয়ান। পরবর্তীতে ০১ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।[৪]
আন্দোলনে সাহায্য করার কারণে অথবা নিছক আন্দোলন চলাকালীন রাস্তায় থাকলেও পুলিশের দ্বারা বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতেন রিকশাচালকগণ। এসব হয়রানি উপেক্ষা করে তারা রাজপথে থেকেছেন। আন্দোলনের সময় বিনা ভাড়ায়ও ছাত্রদেরকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন অনেকে। আবার আহতদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যেতেও অনেক রিকশাওয়ালা কাজ করেছেন তখন।[৫]
সেই বিপদের সময়ে অ্যাম্বুলেন্স সহজলভ্য ছিল না। আহতদের বহনে ব্যাপকভাবে রিকশা, সিএনজি ব্যবহার করা হয়েছে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তারা।
এভাবে জুলাই আন্দোলনের সেই উত্তপ্ত, অস্থির দিনগুলোতে আন্দোলনে সাহায্য করে রিকশাওয়ালা, সিএনজি চালকসহ শ্রমজীবী মানুষেরা হয়ে উঠেছিলেন আন্দোলনের সক্রিয় অংশ। আবার বিভিন্ন হকার, ছোট মুদি দোকানদার, ফল বিক্রেতা—এমন অনেকে কেক, বিস্কুট, স্যালাইন, পানি, মাস্ক এগুলো ফ্রি বিতরণ করেছেন। যেমন, ১৮ জুলাই আন্দোলনের সময় আমি যেখানে ছিলাম, সেখানে দেখেছি একজন ফেরিওয়ালা ফ্রিতে আন্দোলনকারীদের টোস্ট বিতরণ করছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন বেশ কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, যেখানে দেখা গিয়েছে যে, কোনো ফল বিক্রেতা ফ্রিতে ফল বিতরণ করছেন, কেউ পানি বিতরণ করছেন অথবা কেউ ফ্রিতে আন্দোলনকারীদের নাস্তা দিচ্ছেন। তোমাদেরও হয়তো এমন অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে আন্দোলনে।
এভাবে আন্দোলনের সেই উত্তাল সময়গুলোতে পথশিশু, রিকশাচালক, হকার প্রভৃতি শ্রমজীবী বা সমাজের নিম্নস্তরে থাকা মানুষগুলো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। যখন প্রয়োজন ছিল তখন তারা নির্দ্বিধায় রক্ত দিয়েছে, অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে জীবনটুকু। আজ প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় শাসক তাদের ভুলতে বসেছে। তাদের অবদানের স্বীকৃতি তারা পায়নি, আহতরা পায়নি সুচিকিৎসা। রাজা আসে, রাজা যায়; দিন বদলায়, বদলায় শাসনকর্তা - কিন্তু তাদের অবস্থা বদলায় না। ক্ষুধার কষ্ট বুকে চেপে রেখে পথশিশুরা আজও রাস্তায় ঘুমায়। শহীদেরা আজ বিস্মৃত, আহতেরা বয়ে বেড়ায় অভ্যুত্থানের গদগদে ঘা, পরিবর্তনের শেষ চিহ্নটুকু আজ এক পঁচা-গলা পাহাড়সম বোঝা। তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের দায় আমাদের। তাদের অবদান এবং অংশগ্রহণ যেন আমরা ভুলে না যাই।
তথ্যসূত্র:
১) কালের কণ্ঠ. (৩১ জুলাই, ২০২৪), এক পায়ে ভর দিয়ে রাজপথে ছিলো শিশু রাকিব। Quota Reform movement [Video]. YouTube. https://tinyurl.com/57y8vts3
২) যমুনা টিভি, (২৫ অক্টোবর, ২০২৪), মৃত্যুকে ভয় না করে অভ্যুত্থানের অংশ হন নুর মোহাম্মদ | Rickshaw Puller Nur Mohammod | Jamuna TV [Video]. YouTube. https://tinyurl.com/ewc4juf5
৩) যমুনা টিভি, (১৮ জানুয়ারি, ২০২৫), হৃদয়বিদারক দৃশ্যে দেখা গেলো রিকশাচালক ইসমাইলের করুণ মৃত্যু | Shaheed Ismail Case | Jamuna TV [Video]. YouTube. https://tinyurl.com/2ymwdyct
৪) আরটিভি নিউজ, (১ অক্টোবর, ২০২৪), মারা গেলেন গুলিবিদ্ধ রিকশাচালক সুফিয়ানও, rtvonline.com. https://tinyurl.com/h493ybt4
৫) চ্যানেল আই নিউজ, (১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪), আন্দোলনে রিক্সা চালকদের ভূমিকা || ডেড লাইন ৩৬ জুলাই || পর্ব: ৬ || Channel i News [Video]. YouTube. https://tinyurl.com/3wuh7xkm