০৪ আগস্ট, ২০২৪। রবিবার।
ফজরের পর বাসায় এসে খুব গোপনে ব্যাগ গুছাচ্ছিলাম। গতদিনও শহরে বেশ মারামারি হয়েছে। বাসায় কোনোভাবে জানতে পারলে একদমই বেরোতে দিবে না। তাই প্রস্তুতি গোপনেই নিতে হচ্ছিল। ভাই, আম্মু, আব্বু - কাউকে বুঝতে না দিয়ে ব্যাগের ভেতরে আমার নানচাকু, হাফ-লিটার পানির বোতল ভরে নিলাম। আর টাওয়েলটা উঠিয়ে রাখলাম, ফোনেও ফুল চার্জ দিয়ে রাখলাম। সারাদেশে নেট অফ, তবে কল বা মেসেজ দেওয়া যাচ্ছে।
সকাল ১০ টায় বাজার স্টেশনে থাকতে হবে, সেখানেই আজকের আন্দোলন শুরু হবে। বেরোতে বেরোতে একটু লেট করে ফেললাম। সকাল তখন সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। কোনো রকমে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সন্তর্পণে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।
রাস্তায় অনেক প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের সাথে দেখা হচ্ছিল। সবাই বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগল কোথায় যাচ্ছি। বলল, বাজারের দিকে ঝামেলা হচ্ছে ওদিকে যেন না যাই। কৌশলে মুচকি হেসে সবাইকে পাশ কাঁটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
শিয়ালকোল বাজার পর্যন্ত হেঁটেই আসলাম। তবে এখানে এসে আশাহত হলাম। পুরো রাস্তা একটু পর পর ব্লক করে রাখা। একটা গাড়িও যেতে পারছে না, এখন শহরে যাব কীভাবে? বাজারে একটু রেস্ট নিয়ে গলায় আইডি কার্ডটা ঝুলিয়ে নিলাম। এদিকে ১০ টা পার হয়ে গেছে। রাস্তায় অনেক মানুষ। এই বাজারেই থাকব নাকি শহরের দিকে যাব? একটু কনফিউজড হয়ে গেলাম। এতদূরে হেঁটে যেতে অনেক সময় লাগবে, অনেক কষ্টও হবে। কোনো সমস্যা হলে বাসায় আসতেও ঝামেলা হবে।
ভাইকে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দিলাম, আমার শাহাদাতের জন্য দুআ করতে আর বাসায় ম্যানেজ দিতে। ভাইকে না জানিয়ে এসেছি জন্য একটু বকা দিল, তবে অনেক খুশিও হলো। কিছুদিন আগে বাসায় আসার পর ক্যাম্পাস সেন্টার্ড হয়ে যাওয়ায় সিরাজগঞ্জে বেরই হওয়া হয়নি। তাই দুইজনই কষ্টে ছিলাম। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত পরিবারকে দেখে রাখার কথা বলে শহরের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।
রাস্তায় একা যেতে কষ্টই হচ্ছিল। সফরসঙ্গী ছাড়া একা যাওয়া যেমন রিস্কি তেমনই বোরিং-ও। ভাইয়ের বন্ধুরা সবাই শিয়ালকোল বাজার থেকে আগেই শহরে চলে গেছে। এতদিন সবাই শিয়ালকোল বাজারেই আন্দোলন করেছে। সেন্ট্রালি আজকে বাজার স্টেশনে সবাইকে যেতে বলেছে, তাই ভাইরা ১০ টার দিকেই শহরের দিকে চলে গেছে। বাজারে এসে ভাইদের কল দেওয়ার পর তারা বলেছিলেন, বাসায় চলে যেতে নাহলে বাজার স্টেশনে যেতে।
যাই হোক, দৃঢ় মনোবল নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়লাম শহরের উদ্দেশ্যে। একটু পর রাস্তায় দেখি আমার ছোট কাজিন আর ওর বন্ধু। আমাদের পুরো বংশে একমাত্র এই কাজিনই ‘টোকাই’ নামে পরিচিত। এলাকায় যত মারামারি আর ঝামেলা আছে - ও সবার আগে চলে যাবে। গ্রামের বখাটেদের সাথে মিশতে মিশতে ও পুরোপুরি বখাটে হয়ে গেছে। সাথে একটা চেলাও এসেছে। ওইটাও বখাটে। ওরই শিষ্য হবে হয়তো।
আমাকে দেখে লজ্জা পেয়ে গেল। এই বংশের ভদ্র কোনো ছেলে আন্দোলনে যাবে ওরা এক্সপেক্ট করেনি, সমাজের ‘good boy’-রা তো এসব করে না। যাই হোক, আমি ওদের দেখে বুঝে গেলাম, কোন দিকে কী উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। কাছে ডেকে নিয়ে অভয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আন্দোলনে যাচ্ছে কিনা। হ্যাঁ, ঠিকই দুইজন যাচ্ছে শহরের দিকে। বললাম, চল্ আমার সাথে।
ওদের দুইজনকে একটু ভালোভাবে খেয়াল করলাম। না, কোনো প্রস্তুতি নেই। পানি, টাকা এমনকি কাছে কোনো ফোনও নেই। আমি তো অবাক, এই টোকাইদের নিজেদের লাইফ নিয়ে কি একটুও মায়া নাই? ওদের কিছু হয়ে গেলে পরিবারের কী হবে একটু চিন্তাও করে নাই?
আমার ন্যানচাকুটা দেখালাম ওদের। বললাম, তোরাও কিছু নিয়ে নে। গাছের ডাল ভেঙ্গে লাঠি বানিয়ে নিল। আমি তো মনে মনে বেজায় খুশি। যাক, ওদের সাথে গল্প করে যেতে পারব। আবার একটা দায়িত্বও পেয়ে গেলাম। ওদেরকে দেখে রাখতে পারব। ওরা তো কোনো প্রিপারেশন নিয়ে আসেনি। আমার কাছে তো সবই আছে। ওদেরকেসহ আন্দোলনের সবাইকে ভালো সাপোর্টও দিতে পারব।
রাস্তায় ওদেরকে জ্ঞান দিতে দিতে নিয়ে চললাম। ঢাকার তেমন আপডেট জানে না ওরা। ন্যারেটিভ, পলিটিক্স, কৌশল কিছুই বোঝে না ওরা। ওদের কাছে কোনো ফোন বা ডিভাইসও নাই। শুধু মাত্র স্টুডেন্টদের আন্দোলন, ছাত্রলীগ মারতে হবে, পুলিশ মারতে হবে, আন্দোলন করতে হবে, কারণ পুলিশ আমাদের ভাইদের মেরেছে - এতটুকুই জানে। এই ছোকরারাও বলছে, হাসিনা আলেমদের মারছে, ছাত্রদের মারছে, ওর তো খবর করেই ছাড়ব, ওর পতন নিশ্চিত, ওর বিচার হবেই। আমি অবাক দৃষ্টিতে ওদেরকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। কাজিন ক্লাস নাইনে পড়ে। পড়ে বলা কঠিন, কারণ লাস্ট কবে স্কুলে গেছে ও নিজেও জানে কিনা সন্দেহ আছে। সাথের টোকাই আকাশ তো পড়াশুনাও করে না। বাপ-মায়ের সম্পর্ক নাই। মা নাকি পরকিয়া করে অন্য পুরুষের সাথে ভেগে গেছে।
এলাকায় আসা হয় না, মাঝে মাঝে আসলেও ওদের সাথে একদমই কথা বা দেখা হয় না। বাপ-মায়ের অবস্থার সাথে সাথে আকাশের অবস্থাও খারাপ। নেশার জগতে চলে গেছে। এলাকার বখাটে পোলা। মাঝে মাঝে অটো চালায়, ওই টাকা দিয়ে নেশা করে। স্কুলে যাওয়ার টাকা দিবে কে? পড়াশুনা করাবে কে? ওর কথা শুনে নিজের জীবনের দিকে তাকালাম। এত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর কাছে নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করি না। আমাদের কিছু হলে দেখার মতো পরিবার আছে, পুলিশ ধরলে ছাড়ানোর লোক আছে। ও আহত হলে ওকে কে দেখবে? মরে পড়ে থাকলেও তো দেখার কেউ নাই। পুলিশ ধরলে তো জামিনও পাবে না, উকিলও পাবে না। বেশ মায়া লাগল। ভালোও লাগছিল, যাক ওদেরকে দেখার মতো আমি তো আছি এখন। দেখে দেখে রাখব।
শহরে গিয়ে পৌঁছানোর পর দেখি অবস্থা ভালোই খারাপ। ছাত্রলীগ আক্রমণ করেছে, সাথে পুলিশও আছে। বড় ভাইদের ফোন দিয়েছিলাম তাদের সাথে একসাথে থাকার জন্য। স্কুলের কিছু বন্ধুকেও ফোন দিলাম, যেন সবাই একসাথে থাকতে পারি। ভালোই মারামারি চলছে। সবার একসাথে এগুতে হবে।
এর মধ্যেই হঠাৎ দেখি আকাশ নাই। কাজিন আর আমাকে রেখে ও ভিন্ন দিকে দৌড় দিয়েছে। ডাকছি, শুনছে না, দৌড়াচ্ছেই। একটু পর দেখি, কোথা থেকে একটা লোহার বেড়া ভাঙল এবং সেটার একটা টুকরো নিয়েই দৌড়ে গেল মারামারির দিকে। সরাসরি সামনের দিকে পুলিশের ওপর আক্রমণ। আমি তো টেনশনে পড়ে গেলাম, ওর কিছু হয়ে গেলে কী করব?
সিচুয়েশন একটু নিয়ন্ত্রণে এলে ওকে খুঁজতে বের হলাম। না, কোথাও নাই। মারামারি করার জন্য চলে গেছে অনেক দূরে। এদিকে ফিরে এসে আমরা সবাই একত্রিত হলাম। তারপর এগিয়ে গেলাম আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের দিকে। সামনে গিয়ে দেখি লীগের এক ক্যাডার কাউকে রাস্তায় জবাই করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের সামনে আর টিকতে পারেনি। পুলিশ, লীগ সবাই পালিয়েছে।
ওইদিন সিরাজগঞ্জে অনেক মারামারি হয়েছে। অনেকগুলো পুলিশও মারা গেছে। এবং ওইদিনই সিরাজগঞ্জ জালিম বাহিনী থেকে মুক্ত হয়েছে।
বাড়ি ফেরার একটু আগে দেখি আকাশ আমাদের থেকে একটু দূরেই আছে। ওকেও ডেকে নিলাম, তারপর সবাই একসাথে বিজয়ীর বেশে বাড়ির দিকে ফিরতে লাগলাম।
আকাশের বয়স ১৩ কি ১৪ হবে। ওর মতো হাজারো ছেলে সেদিন রাস্তায় নেমেছিল, সবার সামনের কাতারে ছিল, কতজন প্রাণ দিয়েছে তার কোনো হিসাবও নাই। ওরা সেদিন শুধুমাত্র জালিমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ছাত্র ও আলিমদের ওপর আক্রমণ করা লীগ, পুলিশ ও তাগুত হাসিনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ওদের রক্তের মূল্য কি আমরা দিতে পেরেছি? লীগ ও পুলিশের কি বিচার হয়েছে? ওরা তো কোনো রাজনীতি বোঝে না। তবুও নিজেদের জীবন দিয়ে দিয়েছে। আর সেই লাশ ও রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের এই আপাত স্বাধীনতা।