কুরবানি ঈদের পর আমাদের ক্লাস শুরু হতে বিলম্ব হচ্ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে। ছুটি লম্বা হচ্ছে ভেবে একদিকে খুশি হচ্ছিলাম, অন্যদিকে সেমিস্টারের সময় নষ্ট হচ্ছে ভেবে ছিলাম চিন্তায়। যদিও আমি বাড়িতে (কুমিল্লা) থাকিনি। বন্যার কারণে টিউশনিতে অনেক গ্যাপ হয়ে যাওয়ায় ক্যাম্পাস খোলার আগেই চলে গিয়েছি নোয়াখালী৷ সরকারি চাকরির প্রতি আমার কখনোই কোনো আগ্রহ ছিল না। তাই প্রথম থেকেই এ আন্দোলনকে গত ১৫/১৬ বছর ধরে চলা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আর দশটা বস্তুগত দাবি আদায়ের আন্দোলনের মতো মনে হয়েছিল, যেখানে আমার কোনো স্বার্থ নেই। 

আমাদের নোবিপ্রোবিতে প্রথম কোটা বিরোধী আন্দোলন হয় সম্ভবত ১০ জুন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-এর ব্যানারে। সম্ভবত ১৫ জনেরও কম মানুষ সেদিন মিছিল করেছিল ক্যাম্পাসের ভেতরে। তারপর ঢাকার আন্দোলনের সাথে তাল মিলিয়ে এখানেও কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে মিছিলে অভিযাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে। ৭ জুলাই ঢাকায় ব্লকেড ঘোষণা হলে নোয়াখালীতেও প্রথমে ক্যাম্পাসে সংহতি সমাবেশ এবং পরে চৌরাস্তায় সড়ক অবরোধ হয়।

১০ জুলাই, ব্লকেডের চতুর্থ দিন ফাহাদকে নিয়ে ঢাকায় যাই। আমি সহজেই পৌঁছলেও ফাহাদ দেড় ঘণ্টা দেরিতে আসে। গুলশানে জরুরি এক সাক্ষাতে ব্লকেডের কারণে সময়মতো পৌঁছাতে পারিনি। সেদিন রাতে গাড়ি না পেয়ে পরদিন কুমিল্লা আসি। দু’দিন কুমিল্লায় থেকে ১৩ জুলাই সকালেই আবার নোয়াখালী রওনা হই। 

আন্দোলন তখন মাত্র তীব্রতা পেতে শুরু করেছে। ১১ জুলাই কুবিতে প্রথম পুলিশ শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে। এর প্রতিবাদে ১২ জুলাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রথম সুসংগঠিতভাবে ক্যাম্পাসের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে শহরের ডিসি অফিস থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে।

১৪ তারিখও নোয়াখালীতে কর্মসূচি ছিল। সেদিনও আমি বের হইনি। ১৫ জুলাই কুমিল্লায় ছাত্রলীগ প্রথম দুঃখজনক ঘটনার সূচনা করে। জিলা স্কুল মাঠে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। নেতৃত্বে ছিলেন অহি তাজওয়ার ভাই, সাইফুর রাফি, খিজিরসহ অন্যরা। ২০/২৫ জন একত্রিত হতেই ছাত্রলীগের একদল টোকাই-গুন্ডা মাঠে ঢুকে গেইটে তালা দিয়ে নির্যাতন শুরু করে। সবচেয়ে বেশি আঘাত করে অহি ভাই ও রাফি ভাইয়ের উপর। সন্ধ্যায় সবাইকে ছেড়ে দিলেও মিরাজ নামে এক ছোট ভাইকে জিম্মি করে ১০ হাজার টাকা চায়, পরে ৪ হাজার টাকা দিয়ে ভাইয়েরা তাকে ছাড়িয়ে আনে।

অন্যদিকে, ঢাবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর সেদিন সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ অতর্কিত হামলা করে। ভাই-বোনদের রক্তাক্ত ছবিগুলো সহ্য করার মতো ছিল না। কে জানতো সেদিনের ভয়াবহ আক্রমণের চেয়ে আরও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ দেখার জন্য আমরা পুরো জাতি প্রস্তুত হচ্ছিলাম! সেদিনের পর আমি আর নিজেকে ঘরে আটকে রাখতে পারিনি। বিষয়টা এখন আর কোটার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন মাজলুমের পক্ষে এবং জালিমের বিপক্ষে দাঁড়ানো ওয়াজিব হয়ে গিয়েছে। 

আমি সরাসরি আন্দোলনে নামি ১৬ জুলাই। সেদিন শহরের বিশ্বনাথ থেকে সুপার মার্কেট পর্যন্ত মিছিলের কর্মসূচি ছিল। কিন্তু পুলিশের পরামর্শে সমন্বয়করা বড় মসজিদ মোড়েই মিছিলের সমাপ্তি ঘোষণা করে, যা উত্তপ্ত ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। “ভুয়া! ভুয়া!” স্লোগান দিয়ে সমন্বয়কদের পদত্যাগের দাবিও ওঠে। মেসে ফেরার পথে কিছু সমন্বয়কের কাছে জানতে পারি, আওয়ামী লীগের গুন্ডারা নাকি যুবলীগ অফিসে অস্ত্র নিয়ে অপেক্ষায় ছিল। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতেই মিছিল সংক্ষিপ্ত করেছে। তবে শিক্ষার্থীদের মত ছিল, ঢাকায় যখন ভাই-বোনদের রক্ত ঝরেছে, প্রয়োজনে আমরাও রক্ত দেবো। সেদিন নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগ বা অন্যকেউ কোনো হামলা চালায়নি। এমনকি আন্দোলনের শেষ অবধি পুলিশ বা আওয়ামী লীগের গুন্ডারা কেউই নোয়াখালীতে ছাত্র-জনতার উপর সরাসরি বড় ধরনের আক্রমণ করতে পারেনি। তবে গোপনে হুমকি, তুলে নিয়ে অত্যাচার করা, আটকে রাখা, মামলা দেওয়া ইত্যাদি চলেছে আন্দোলনের শেষ পর্যন্ত।

ইতিমধ্যে সরকারি নির্দেশনায় সকল ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। ১৭ জুলাই রাতে বাবা কল দিয়ে ভয় ও আশঙ্কা প্রকাশ করেন এবং দ্রুত কুমিল্লা চলে যেতে বলেন। ১৮ তারিখ সকালেই কুমিল্লার উদ্দেশ্যে মেস থেকে বেরিয়ে যাই৷ 

১৯ জুলাই থেকে ইন্টারনেট শাটডাউন, দেশব্যাপী কারফিউ। এই সময়টা কল্পনা করলে এখনো গা ছমছম করে ওঠে। কারও সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। মোবাইল নেটওয়ার্কও বাজে অবস্থা৷ কাছের মানুষের খোঁজখবর নেওয়াই যেন দু:সাধ্য হয়ে উঠছিল। উপায়ান্তর না পেয়ে যোগাযোগের জন্য সিমে টেক্সট মেসেজের অফার কিনতে হয়েছে।

যাই হোক, সেই সময়টা ঘরেই কাটাই। ভয়, শংকা আর চাপা আতংক নিয়ে৷ শুনতে পাই, যারাই আন্দোলনের পক্ষে ফেসবুকে লেখালেখি করেছে, তাদের বাসায় রাতে পুলিশ-র‍্যাব অভিযান চালাচ্ছে, তুলে নিয়ে যাচ্ছে। পাশের গলি থেকেই স্কুলপড়ুয়া একজনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথাও শুনতে পাই। নিজের অবসর সময়টা কাটানোর কোনো উপায়ান্তর না দেখে বই পড়া শুরু করি। আমার মনে হয়, আগের ছমাসে যতটুকু পড়েছি, তার চেয়ে বেশি পড়েছি ইন্টারনেট শাটডাউনের সেই এক সপ্তাহে।

২৪ জুলাইয়ের পর থেকে ইন্টারনেট ফিরে আসলে একে একে সামনে আসে এই কয়েকদিনের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের ফুটেজ৷ এরপর থেকে ধীরে ধীরে কুমিল্লায় আন্দোলন আরও তীব্র হয়। বিশ্বরোড ও কুবির গন্ডি পেরিয়ে আন্দোলন এবার সংগঠিত হতে থাকে শহরের কেন্দ্র থেকেই।

২৬ জুলাই, শুক্রবার। নামাজ পড়তে গেলাম ঝাউতলা জামে মসজিদে। কর্মসূচি ছিল জুমার পর কান্দিরপাড় থেকে বিক্ষোভ মিছিল। কিন্তু নামাজ শেষে দেখি, মসজিদের সামনেই চারদিক থেকে লোকজন জমা হচ্ছে। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি, মসজিদের বিপরীত পাশে আমাদের সাথেই নামাজ পড়া টুপি-পাঞ্জাবি পরা একদল লোক মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। জানা যায়, তারা ব্যাগভর্তি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা বাড়ে। কয়েকজনকে চিনতে পারি, আমাদের এলাকাতেই থাকে, স্থানীয় যুবলীগ-ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত। আমার ভেতর হালকা ভয় কাজ করছিল। তাদের আর আমাদের মাঝে দূরত্ব মাত্র দুই লেনের বৃষ্টিভেজা রাস্তা। কয়েকজন বন্ধু এবং ছোট ভাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিলাম, বিপদের আশঙ্কা আছে তাই। 

প্রায় ১৫/২০ মিনিট রুদ্ধশ্বাস অবস্থানের পর একটা অবাক করা ঘটনা ঘটে৷ পুলিশ লাইনের দিকে ৩/৪ জন স্লোগান দিয়ে এগিয়ে গেল। এরা কেউই আগে থেকে আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল না। মিছিলটা পুলিশ লাইন অতিক্রম করে রেসকোর্স ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে মাঝখান অবধি গিয়ে আবার ফিরে আসে। 

সেদিনের পর থেকে সবার মনে ভয়-শংকা আরও দানা বাঁধতে থাকে। রাত হলে সবাই প্রস্তুত থাকতাম যেকোনো মুহূর্তে পুলিশ-প্রশাসনের লোক আসতে পারে। আম্মু আমার বেশিরভাগ ইসলামী বই সরিয়ে রেখেছিল। মোবাইল থেকে ডিলিট করে দিয়েছিলাম আন্দোলনের ছবি, লীগের অপকীর্তির প্রমাণ সমেত সব ছবি-ডকুমেন্ট। 

তারপর আসে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ ও দেয়াল লিখন কর্মসূচি৷ নানান জায়গা থেকে খোঁজখবর নিই শহরে কে দেয়াল লিখনের কাজ করতে পারে৷ আমি ও ফাহাদ মিলে সিদ্ধান্ত নিই ফজরের পর মুখে কাপড় পেঁচিয়ে দেয়াল লিখন হবে। পরে সেটা আর হয়ে ওঠেনি৷ 

এভাবেই আসে ৩রা আগস্ট। আন্দোলনে কুমিল্লার সবচেয়ে ভয়াবহ দিন। শিক্ষার্থীরা জড়ো হয় জিলা স্কুল গেইটে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের গুন্ডারা সেখানে যাওয়ার সকল রাস্তা ব্লক করে রাখে। রাজগঞ্জ দিয়ে ঘুরে ঈদগাহে প্রবেশ করার গলিপথটা ছিল শুধু সাধারণ ছাত্রদের দখলে। আমরা ঘুরে সেই রাস্তা দিয়েই যুক্ত হলাম। সেখানে গিয়ে দেখি যেই ছেলেটা একদিনও আন্দোলনে নামেনি, সেও নেমে এসেছে। বাবা-মায়ের সাথে এসেছে স্কুল পড়ুয়া বাচ্চারা।

আমাদের বিপরীতে কয়েকশো হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কখনো তারা আমাদের দিকে কয়েক পা এগিয়ে আসে, কখনো আমরা আগাই। সবার হাতেই ছিল বাঁশ, গাছের ডাল কিংবা ছোট পাথর। প্রায় দুই ঘণ্টা স্লোগান, গান আর প্রতিরোধের মধ্যে অবস্থান চলে। একপর্যায়ে তারা একপাশে সরে যায়, আমরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাই। মোড়ে মোড়ে আটকে পড়া অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষ আমাদের সাথে যুক্ত হয়। জেলখানা মোড় পেরিয়ে পুলিশ লাইন চত্বরে পৌঁছতেই হঠাৎ চারদিকে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। কিছু বোঝার আগেই মুহুর্মুহু গুলির শব্দ শুনি। প্রাণভয়ে আমি দৌড়ে ফায়ার সার্ভিস অফিসের পাশের দীঘির সামনে দিয়ে বাসায় ফিরে আসি।

অনেকেই আহত হলেও কেউ মারা যায়নি সেদিন। কুমিল্লার এই ভয়াবহ হামলার খবর বারুদের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। “All Eyes on Cumilla” হ্যাশট্যাগে ফেসবুক ভরে যায় সন্ত্রাসীদের নির্মমতার ছবি-ভিডিও দিয়ে৷ সবচেয়ে নির্মম ছিল পুলিশ লাইন মসজিদের বাইরের গেইটে নির্বিচারে ৩/৪ জন বোনদের উপর সন্ত্রাসীদের লাঠি দিয়ে মারার দৃশ্য। হয়তো এই হামলার তীব্রতা ও দেশব্যাপী প্রতিক্রিয়া দেখেই সেদিন বিকেলে শহীদ মিনার থেকে সমন্বয়করা ঘোষণা দেয় ঐতিহাসিক এক দফার; “স্বৈরাচারের পতন”৷ আন্দোলনের নেতারা ঘোষণা করার আগেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে–এই সরকার ও খুনি হাসিনার পতন চায় সকলে।

৪ আগস্ট আবারও বিশ্বরোড অবরোধের চেষ্টা করে ছাত্র-জনতা। কিন্তু এদিনও শহরের চারদিক থেকে বিশ্বরোডে ঢোকার সকল রাস্তায় অবস্থান নেয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। কিছু মুখোমুখি সংঘর্ষে অনেকেই সেদিন আহত হয়। প্রাণভয়ে আশেপাশের বাড়িগুলোতে অবস্থান নেয় শত শত শিক্ষার্থী।

সমন্বয়করা প্রথমে ৬ আগস্ট লং মার্চ টু ঢাকার কথা বললেও ৪ তারিখ চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতা দেখে ৫ই আগস্ট লং মার্চের ঘোষণা দেওয়া হয়।

৪ তারিখ রাত থেকেই মোবাইল ও টিভিতে ঢাকায় যেতে দেখি অনেক মানুষকে। ৫ তারিখ বেলা সাড়ে ১২/১ টার পর থেকে শুনতে পাই সেনাপ্রধান বক্তব্য দিবে। দুপুর প্রায় ২ টার দিকে যখন টিভিতে হেডলাইন দেখি, “খুনি হাসিনা পালিয়েছে”, তখন মনে হচ্ছিল আমরা বিরাট কোনো যুদ্ধে জয়লাভ করলাম। জাতি হিসেবে আমাদের মুক্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ ফেলতে পারলাম; যে মুক্তির জন্য আমাদের হয়তো অপেক্ষা করতে হবে আরও অনেকগুলো বসন্ত…