চুলের সিঁথি দেখেই বোঝা যায় সবুর একজন নম্র-ভদ্র এবং পরিপাটি ছেলে। চুলে তেল দিয়ে একপাশে শুইয়ে দেয় আর মাথার বাঁ দিকে সিঁথি করে। শার্ট আর প্যান্টে সবুরকে অনেক সুন্দর লাগে। দেখতে যেমন পরিপাটি, কথাবার্তা, নম্রতা ও ভদ্রতার দিক থেকে অন্য দশজন ছেলের থেকে ভিন্ন। গলায় গামছা বেঁধে ঝুলিয়ে বাদাম-বুট বিক্রি করে সংসার চালায় অল্পবয়সী সবুর। পড়ালেখা তেমন করতে পারেনি, স্কুলে সিক্স পর্যন্ত পড়েছিল। সবুরের যখন তেরো বছর, তখন তার বাবা মারা যায়। তাই আর পড়াশোনা আগাতে পারেনি; সংসারের হাল ধরতে হয় সবুরকে। পরিবারে মা এবং ছোটবোন জুঁই। মা অন্যের বাসায় কাজ করে অল্প উপার্জন করে আর সংসারের বাকিটা সবুরকেই দেখতে হয়।

প্রতিদিন বিকেল হলেই বাদাম-বুটের ডালা গলায় নিয়ে সবুরের দেখা মিলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আশেপাশে। সবাই নিয়মিত সবুরের সাথে দেখা না করলেও জাবি’র এক বড় ভাই, মোবারক, তিনি প্রতিদিনই সবুরের কাছ থেকে বাদাম কিনেন দশ টাকার। কিন্তু দেন বিশ টাকা। মোবারক ভাই সবুরের নিয়মিত কাস্টমার। সবুরের পরিবার সম্পর্কে সবই জানেন তিনি। তাই তার সহমর্মিতা হিসেবে দশ টাকার বাদাম কিনে ২০ টাকা দেওয়াটাই যেন তার নিত্যদিনের অভ্যাস। মোবারক ভাইয়ের ভালোবাসা পেয়ে সবুরও খুব খুশি হয়। প্রতিদিন মোবারক ভাই এসেই মাথায় হাত বুলিয়ে সবুরের কাছে জানতে চায় বাড়িতে মা ও ছোট বোনটা কেমন আছে।

জুলাই থেকে যখন কোটা নিয়ে সারাদেশে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়, তখন থেকেই মোবারক ভাই আন্দোলনে রাজপথে ছিলেন। সারাদিন নিজের ব্যবসার কাজে সময় দিয়ে সন্ধ্যা কিংবা রাতে বেশিরভাগ সময়েই সবুরকে দেখা যেত মোবারক ভাইয়ের আশেপাশে। ১৬-ই জুলাই যখন প্রথম ছাত্র শহীদ হয়, তারপর থেকেই তো সারাদেশে শুরু হয় উত্তাল পরিস্থিতি। ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকে আন্দোলনের ভয়াবহতা। বাড়তে থাকে মৃত্যুর সংখ্যাও।

এদিকে সবুরের ব্যবসা আগের মতো আর হয় না। কারণ সবাই আন্দোলনে ব্যস্ত। অবসর সময় ক্যাম্পাসের আশেপাশে কেউ আর বসে থাকে না। তাই সবুরের বেচাকেনাও তেমন হয় না। তবুও বিকেল হলে সবুর ক্যাম্পাসের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে এবং সুযোগ পেলে মোবারক ভাইয়ের দেখাও মিলে। ১৮-ই জুলাই সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। টানা সাত দিন ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকে। কারফিউ, অবরোধ নানা কর্মকাণ্ড চলতেই থাকে একের পর এক।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থমথমে অবস্থা; ক্যাম্পাসে কেউ নেই। সবাই আন্দোলনে যোগ দেয়, কেউ কেউ চলে যায় ঢাকার মেইন পয়েন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে। এখন আর কোনোভাবেই ক্যাম্পাসে বেচাকেনা করতে পারে না সবুর। তাই আর মোবারক ভাইয়ের সাথেও দেখা হয় না।

জুলাই দেখতে দেখতে শেষ হলে আগস্টের শুরু থেকেই ছাত্র আন্দোলনের টার্গেট হয় স্বৈরাচারের পতন। সেই আন্দোলনে একের পর এক বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সমন্বয়করা। সবুরের সাথে মোবারক ভাইয়ের দেখা-সাক্ষাৎ নেই প্রায় ছয়-সাত দিন। ৩রা আগস্ট হঠাৎ সবুরের সাথে মোবারক ভাইয়ের দেখা হয়ে যায়। দেখা হওয়া মাত্রই সবুরকে বুকে টেনে নেয় মোবারক ভাই। সে কেমন আছে, বাড়ির মা ও ছোট বোন কেমন আছে - সবই জানতে চায়। অনেক কথা শেষে বলে, “সাবধানে থাকিস। আর ঘর থেকে বের হওয়ার প্রয়োজন নেই। দেশের পরিস্থিতি ভালো না।” সবুর বলতে থাকে, “ভাই, আমি আপনার সাথে আন্দোলনে যাইতে চাই, আমারে আপনার সাথে নিয়া নেন।” কোনোভাবেই মোবারক ভাই সবুরকে সাথে নিতে চায় না। বলে- “তোর যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে তোর পরিবারের দেখাশোনা করার কেউ থাকবে না। তাই তুই পরিবারের সাথেই থাক, আর সাবধানে থাক।” এই বলে মোবারক ভাই চলে যায়।

সবুর মোবারক ভাইয়ের কথা রাখলেও আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য তার মন খুবই ছটফট করে। স্বৈরাচারের নির্যাতন থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার আন্দোলন। তাই সেও আর ঘরে বসে থাকে না। তাড়াতাড়ি সেও ছাত্র আন্দোলনের সাথে যোগ দেয়। সবুরের একটাই আশা- “আমরা বিজয়ী হব, আমরা স্বাধীন হব, আমরা বিজয় দেখব।” এই কথা বলে বলে সবুর আন্দোলনে যোগ দেয়। ৪ তারিখ সারাদেশে প্রায় একশোর বেশি ছাত্র-জনতার নাম মৃত্যুর তালিকায় উঠে আসে। ঘোষণা হয় ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ ৫-ই আগস্ট। সবুরের ইচ্ছা থাকলেও উপায় থাকে না কারণ হাতে কোনো টাকা নেই। তাই জাবি-র আশপাশের এলাকায় সে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে, কী হয় পরিস্থিতি। আর শুধু অপেক্ষা করে একটি বিজয়ের।

৫-ই আগস্ট সবাই অপেক্ষমান - কী হবে পরিস্থিতি? স্বৈরাচার পদত্যাগ করবে নাকি মৃত্যুর মিছিল বেড়ে যাবে? বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না। ঠিক যখন সূর্য মাথার উপর, তখনই স্বৈরাচার পদত্যাগ করে নিজ থেকে পলায়ন করে। এ খবর শুনেই সবুর এক দৌড়ে বাড়িতে চলে যায়। জুই! জুই! বলে ডাকতে থাকে। “মা, মা কই আছো! এহানে আহো। স্বৈরাচার পলায় গেছে, আমরা এহন স্বাধীন”। এই বলে মায়ের কোলে দুই ভাইবোন লুটিয়ে পড়ে। তাদের আনন্দের যেন শেষ নেই।সবুর আনন্দে জাবি ক্যাম্পাসের দিকে দৌড়াতে থাকে, খোঁজ করতে থাকে মোবারক ভাইয়ের। আশেপাশের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে মোবারক ভাইকে দেখছেন নাকি? কেউই মোবারক ভাইয়ের কথা বলতে পারে না। পরে এক ভাই বলে “মোবারক গতরাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সেখানে পৌঁছেও যায়। কিন্তু স্বৈরাচারের বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। মাথায় আঘাত পায়। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হলেও আজ সকালে শহীদ হয় মোবারক।” কথাগুলো শুনে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সবুর মাটিতে পড়ে যায়। আর হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয় সে। “আমার বাদাম কেডা কিনব? কেডা আমার মা-বোইনের খবর জানতে চাইব?” বলতে বলতে কাঁদতে থাকে সবুর।