‘ধ্যাত, ভাল্লাগে না কিছু’
বারান্দায় বসে বসে সামনেরে বিল্ডিংয়ের দেয়াল দেখতে দেখতে বলে আবিদ। এলাকায় নতুন এসেছে সে। আম্মু-আব্বু একদিন কী যেন কথাবার্তা বলল, পরে বলে যে বাসা ছেড়ে দিবে, যাবে নতুন বাসায়।
শহরের বাসাগুলো যেন কেমন, সব গায়ে গায়ে লাগানো। আম্মুকে বলেছিল দেখতে মুরগির খাঁচার মতো লাগে, খেয়েছিল বকা একটা সেদিন। আম্মুরা কি শুধু বকাই দিতে পারে? চিন্তায় পরে যায় সে।
একটা বিড়ালের ডাকে তার চিন্তা ভাঙে। নিচে একটা বাচ্চা বিড়ালের শব্দ পাচ্ছে হঠাৎ।
‘যাক, একটা উসিলা পাওয়া গেল। নিচ থেকে ঘুরে আসি’, ভাবল সে।
ছোট একটা বিড়াল, মা বোধহয় রেখে গেছে। বিড়ালের ডাক শুনে কাছে মনে হলেও বেশ খানিকটা ঘুরে যাওয়া লাগল। হাঁটতে হাঁটতে নতুন একটা খোলা জায়গায় এসে পড়েছে সে। ভক করে নাকে একটা দুর্গন্ধ লাগল, "উরে আল্লাহ, এত ময়লা কেন!"
একপাশে কী যেন একটা লিখা, বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে একটু কাছে যায় দেখতে।
বড় বড় করে লিখা—
‘উন্মুক্ত খেলার মাঠ’
নিচে ছোট ছোট করে লিখা
‘ময়লা ফেলা নিষেধ’
‘ধ্যাত্তীরি! এ বলে খেলার মাঠ!’
কথাটা মনে হয় ও জোরেই বলে ফেলল। পাশে এক ছেলে এসে বলে-
‘হুম, ছিলই তো, কত খেলতাম।’
একটু অবাক হয়েই দেখল ছেলেটাকে, সুন্দর পরিপাটি পোশাক, পায়জামাটা আবার পরেছে একটু উঁচু করে। দেখে শহুরে ছেলেই মনে হয়, কেমন যেন গোবেচারা ভাব। কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কে জানে।
- আসসালামু আলাইকুম, আমি নাবিল, পাশেই থাকি। ক্লাস নাইনে পড়ি।
- ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আমি আবিদ, আমিও নাইনে।
- অনেক দিন ধরেই এখানে আর খেলা যায় না।
- কেন?
- এই যে দেখ ময়লা ফেলে রাখসে, আবার সন্ধ্যায় দেখবা জুয়া-গাঁজার আসর বসছে।
- ওহ!
- আমরা কয়েকজন মিলে চাচ্ছি কিছু একটা করতে, তুমি আসবা নাকি?
এর মধ্যেই বিড়ালটা বেশি চিল্লাফালা শুরু করল। দূরে একটা বড় বিড়ালও দেখা যাচ্ছে। ওর মা মনে হয়। শহুরে ছেলেরা একটু মুরগি টাইপের মনে হয় আবিদের কাছে। তাই এই সুযোগে সে ভাবল কেটে পড়ি।
- আচ্ছা, আজকে আসি।
- আচ্ছা যাও।
…
পরদিন সন্ধ্যা হতেই সে মাগরিবের পর ওই মাঠে চলে যায় একা একাই।
‘একাই সব করি আমি। নো লোকজন, নো প্যারা, নো টেনশন!’
গিয়েই দেখে ৪-৫ জন গোল হয়ে বসে কী যেন করছে। আর বেশ বাজে গন্ধ। একটু সাহস করে সামনে এগোয়।
একটু কাছে যেতেই একজন জোরে বলল-
‘এই পোলা কৈ চাইয়া থাকস! নামায পইড়া বাসায় যা, এহানে কী কাম!?’
‘না মানে, ইয়ে’ বলে চট করে ঘুরে দেয় একটা দৌড়। এক দৌড়ে চার তলা উঠে যায়।
‘কী হইসে তোর? এত হাঁপাচ্ছিস কেন?’
‘তেমন কিছু না আম্মু’, তৃতীয় গ্লাস পানি খেয়ে বলে আবিদ।
‘একটু আসতেসি’ বলেই আবার বের হয়ে যায় আবিদ।
এখন যাওয়া লাগবে সবুজ ভাইয়ের কাছে। উনি ওদের পাশের বাসা থাকে। ৫৬ ইঞ্চি বুকের ছাতি, বড় বড় ড্রাম দিয়ে ব্যায়াম করেন। উনাকে দেখলেই ওদের পেচ্ছাব হয়ে যাবে।
[ঠক ঠক]
- কে?
- ভাইয়া, আমি আবিদ, পাশের বাসার।
- হ্যাঁ, বল [দরজা হাল্কা ফাঁক করে ভাইয়া বলেন]
এক নিশ্বাসে পুরো ঘটনা বলে শেষ করে আবিদ।
- তো.. তো কী হয়েছে, গিয়েছ কেন ওইখানে। আ... আমিই তো ওদিকে পা মাড়াই না সহজে। আর কখনো যাবে না। তাহলে তোমার আম্মুকে বলে দিব।
ভাইয়ার কপালে ঘাম দেখেই ওর বোঝা শেষ। মন খারাপ করে বাসায় এসে না খেয়েই শুয়ে পড়ে। চোখ লাগার আগ মুহূর্তে ওর কানে বাজে নাবিলের কথা। সকালেই ওকে খুঁজে বের করতে হবে।
…
সকাল হতেই আবিদ তড়িঘড়ি করে স্কুলের জন্য রেডি হচ্ছে। আম্মু তো অবাক, ‘কীরে আজকে তোর ফোন গিলা কৈ?’ আমার খাবার সময় ফোন স্ক্রল করাকে আম্মু রাগের চোটে ডাকেন ‘ফোন গিলা’।
- আজকে অনেক কাজ আম্মু, তাড়াতাড়ি যাইতে হবে স্কুলে।
- আচ্ছা যা, সাবধানে যাস। ফি আমানিল্লাহ।
স্কুলে গিয়েই খোঁজা শুরু করে ক্লাস নাইনের নাবিলকে। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বলে, ‘অরে চিনস না? অই তো ফার্স্ট বয়। ঐযে দেখ ফার্স্ট বেঞ্চে বসা।’
আবিদ দেখে ঐযে প্যান্ট উঁচুতে পরা ছেলেটা ডাইরিতে কি যেন লিখছে। আবিদ সাবধানে কাছে গিয়ে বসে। কী যে আজেবাজে ভেবছিল ওকে। একটু গলা খাকড়িয়ে বলে,
- আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, নাবিল। কেমন আছ?
- ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আরেহ আবিদ, কী অবস্থা? আমি ভালো আলহামদুলিল্লাহ।
- না মানে, সেদিনের পর তো আর কথা হয়নি, ভাবলাম তুমি হয়তো এখানেই পড়ো।
- হ্যাঁ হ্যাঁ, ঐযে খেলার মাঠের ব্যাপারটা। কী করা…
হঠাৎ ক্লাসের ঘণ্টা পড়ে গেল, পরে কথা হবে এই কথায় আবিদ তার সিটে এসে বসল।
টিফিনের ঘণ্টার পর ওরা আবার সুযোগ পায়। এবার নাবিল আরও তিন জনকে নিয়ে আসে।
‘এরা হলো আরিফ, মাসনুন আর অরণ্য। আমরা চার জন অনেক দিন ধরে প্ল্যান করছি কিছু একটা করার।’ নাবিল সবাইকে একবার পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘আর কথা না বাড়িয়ে, চলো আজকে একটা প্ল্যান ফাইনাল করি।’
বিকাল ৫ টা বাজে, আসরের পর সবাই এসেছে ঐ মাঠে। হাতে বস্তা, ঝাড়ু আর কোদাল। পূর্ণদ্দোমে শুরু করে ‘মাঠ পরিষ্কার’ মিশন। মিনিট দশেক পর তাদের সাথে যোগ দেয় আরও ২-৩ জন। মাগরিব হতে হতে তারা দেখে মাঠ পুরো সাফ! আর তাদের সাথে সব মিলিয়ে আছে বিশ জন!
আবিদ দেখে এক পাশে দাঁড়িয়ে সবুজ ভাই একাই একটা একটা বস্তা তুলে তলে রাখতেসেন। ওকে দেখে উনার এগাল ওগাল হাসি। ‘চমৎকার কাজ করসিস রে, গ্রেট!’, গর্বে আবিদেরও ছাতি প্রায় ৫৬ ইঞ্চি হতে চলল। পরক্ষণেই মনে হলো, এটা তো আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সম্ভব হতো কখনো, আর এর সাথে তাদের টিম ওয়ার্ক।
সন্ধ্যায় ওরা দেখে ঐ সর্বহারা বদ পার্টি আর বসারই জায়গা পাচ্ছে না। তা দেখে ওদের খুশি আর দেখে কে!
‘কালকে থেকেই আমাদের টিমের খেলা শুরু ইনশাআল্লাহ! আমরা তো একটা টিম তাই না?’ নাবিল বলল। সবুজ ভাই বলেন, ‘হুম টিম বিচ্ছু!’ আবারও হাসির রোল!
কিন্তু ওদের সামনে আছে আরও চ্যালেঞ্জ...
শিক্ষা: কোনো কাজে একা পারদর্শী হলেই হয় না। দলবদ্ধভাবে কাজে বেশি ফলাফল পাওয়া যায়। দলবদ্ধভাবে কাজ করা একটা স্কিল। এই স্কিল তোমাদের রপ্ত করতে হবে ইনশাআল্লাহ। একটি উক্তি আছে—
‘দ্রুত যেতে চাইলে একা চলো, আর বেশি দূরে যেতে চাইলে চলো একসাথে।’
ইসলাম দলবদ্ধ ধর্ম। জামাতে সালাত, একা সফর না করা এগুলো ইসলামের মৌলিক শিক্ষা। আর একটা বিষয় খেয়াল করো। কোনো ভালো কাজ শুরু করলে দেখবে, প্রথমে কারও সাহায্য তেমন পাবে না। কিন্তু সাহস করে কাজটা শুরু করতে পারলে দেখবে অনেকেই তোমাকে সাহায্য করার জন্য চলে এসেছে। আসলে সমাজে অনেক মানুষই আছে যারা সমাজের জন্য মানুষের জন্য কিছু করতে চায়। কিন্তু লজ্জা, জড়তা, ভয় ইত্যাদির জন্য করতে পারে না। তারা অপেক্ষা করে থাকে কেউ একজন কাজটা শুরু করুক, তাহলে আমরাও সেই কাজে যুক্ত হব। সেই কেউটা তুমি হও! রূপকথার মহানায়ক!
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
[ষোলো জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত]