বাংলাদেশে কিছু শব্দ রয়েছে, যেগুলো শুনলেই অজানা এক ভয়ে গা হীম হয়ে যায়। তেমনই একটি শব্দ—আয়নাঘর। শুনে মনে হতে পারে মেলায় দেখা আয়না-নির্মিত মজার কোনো ঘর, যেখানে নিজের প্রতিবিম্ব বিকৃত হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবের এই ‘আয়নাঘর’ কোনো খেলা বা মজা নয়। এটি হলো এমন এক অন্ধকার জগত, যেখানে মানুষকে গুম করে রাখা হয়। কেউ জানতে পারে না সে কোথায় আছে, বেঁচে আছে কিনা, বা আদৌ কোনোদিন ঘরে ফিরতে পারবে কিনা।
আয়নাঘর: গুম রাজনীতির প্রতীক
‘আয়নাঘর’ বলতে বোঝানো হয় সেইসব গোপন নির্যাতন কক্ষ বা সেলকে, যেখানে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গোপনে কোনো ব্যক্তিকে আটকে রাখে। ‘আয়নাঘর’ হলো সেই ঘর, শেখ হাসিনা রিজিমের মতের বিরুদ্ধে গেলেই যেখানে গুম করে রাখা হতো রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে। সরকারের বিরোধিতা করলেই যে কেউ হয়ে যেত ‘জঙ্গি’। আর ‘জঙ্গিদের’ স্থান হতো আয়নাঘরে। তারপর তাদের ওপর চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন।
‘আয়নাঘর’ ছিল আওয়ামী জাহিলিয়াতের বর্বর গুম রাজনীতির প্রতীক। যে-ই আওয়ামী রিজিম বা তাদের মনিব ভারতের সমালোচনা করত, তার ঠিকানাই হতো আয়নাঘরে। এটি যেন রাষ্ট্রের এক অদৃশ্য কুঠুরি—যা আইন-আদালতের উর্ধ্বে, মানবতা যেখানে ডুকরে কাঁদে। ‘আয়নাঘর’ ছিল শত শত মানুষের আর্তনাদের গল্প। সেখানে সূর্যের আলো অবধি প্রবেশের অনুমতি পেত না।
২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা Human Rights Watch জানায়, “২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে ৬০০ জন গুমের শিকার হয়েছেন।”
যেভাবে গুম হতো নিরপরাধ মানুষ
বাংলাদেশে গত দেড় দশকে শত শত মানুষ গুম হয়েছেন। কাউকে রাতের অন্ধকারে বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে, কাউকে রাস্তা থেকে কালো জানালার সাদা মাইক্রোবাসে করে তুলে নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ঘটনাতেই আইনশৃঙ্খলা ‘রক্ষাকারী’ বাহিনী সাদা পোশাকে অভিযান চালাত।
ভুক্তভোগী পরিবার থানায় জিডি করতে যেত। কিন্তু পুলিশ জিডি নিত না। শেষমেশ তারা সংবাদ সম্মেলন করত। কিন্তু এ-পর্যন্তই। কোনো সমাধান মিলত না। গুম হওয়া ব্যক্তির কোনো হদিস পাওয়া যেত না।
কখনো কখনো মাসখানেক বা বছরখানেক পরে হঠাৎ ফিরে আসতেন কেউ কেউ। কিন্তু কোথায় ছিলেন, কারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল—কিছুই বলতেন না তারা। এভাবেই নির্যাতনের পর ভয় দেখিয়ে কিছু মানুষকে ছেড়ে দিত আয়নাঘরের কারিগরেরা। আর বাকিরা হারিয়ে যেতেন বিস্মৃতির অন্তরালে। নামের আগে ‘নিখোঁজ’ পদটি রয়েই যেত।
যে নির্মমতা হার মানাবে মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও
নির্যাতনের কথা আসলেই আমাদের মাথায় ভেসে ওঠে মধ্যযুগীয় বর্বরতার চিত্র। কিন্তু কয়েকশ বছর পরও যে মানুষের মুখোশ পরে কিছু অমানুষ সেই বর্বরতাকে ছাড়িয়ে যাবে, তা আমাদের কল্পনাতেও আসে না। আয়নাঘর ছিল সেরকমই একটি বিষয়।
আয়নাঘর শুধু গুমখানা ছিল না। সেগুলো ছিল স্পেশাল টর্চার সেল। হাসিনাশাহীর বিরোধিতাকারীদের গুম করে আয়নাঘরে রাখা হতো। তারপর চালানো হতো অবর্ণনীয় সব নির্যাতন। ৫-ই আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে জালিম শেখ হাসিনার পতনের পর নতুন করে আলোচনায় আসে ‘আয়নাঘর’। আয়নাঘর থেকে জীবিত ফিরে আসা অনেকেই তখন মুখ খোলেন। বর্ণনা করেন তাদের জীবনের দুঃস্বপ্নের মতো দিনগুলোর গল্প।
ভাইয়া ও আপুরা, আয়নাঘরের সেই বন্দিদের গল্প পড়লে তোমরা হয়তো অবশ হয়ে যাবে। কী ভীষণ অমানুষগুলো আমাদের আশেপাশে বাস করে ভেবে শিউরে ওঠবে। চলো, সেই গল্পগুলোর অল্প কিছু জেনে আসি।
[১]
২০১৪ সালে র্যাব কর্তৃক অপহৃত হয় ৩০ বছর বয়সী এক যুবক। সৌভাগ্যক্রমে তিনি এক সময় আয়নাঘর থেকে ফিরে আসার সুযোগ পান। তার ওপর নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, একদিন সকালে তাকে একটি চেয়ারে বসায় র্যাব সদস্যরা। বসানোর পর, চেয়ারের সাথে তার হাত-পা, বুক ও মাথা বেঁধে ফেলে। বাঁধার পর র্যাব সদস্যরা তাকে বলে, “এই চেয়ারে কিন্তু সুইচ দিলাম।” তো, তিনি এই চেয়ার সম্পর্কে কিছু জানতেন না। র্যাব সদস্য আবার ওই একই প্রশ্ন করে। এতেও তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। তখন একটি সাধারণ চেয়ারে বসিয়ে আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। তবুও তারা কোনো উত্তর পেল না।

বৈদ্যুতিক শক ছিল একটি বহুল ব্যবহৃত নির্যাতন পদ্ধতি (চিত্রটি প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের বর্ণনার উপর ভিত্তি করে আঁকা)
তখন তারা তার দুই হাত রশি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দিল। ঝুলিয়ে দিয়ে তাকে একদম উলঙ্গ করে ফেলে। তারপর তার গোপনাঙ্গে বৈদ্যুতিক ক্লিপ লাগায়। এরপর তাতে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া শুরু করে। একদিকে বৈদ্যুতিক শক, অন্যদিকে বেতের লাঠি দিয়ে মারা শুরু করল।
পুরো নির্যাতনের ঘটনাটি ঘটে এক ঈদের দিন সকালে। এই ছিল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক নির্দোষ নাগরিককে দেওয়া ঈদের শুভেচ্ছা!
[২]
আরেক তরুণ, যে কিনা মাত্রই কৈশোর পেরিয়েছে, ২০ বছর বয়সে র্যাব কর্তৃক গুম হয়। এক মাসেরও বেশি সময় গুম ছিল সে। তাকেও একইরকম নির্যাতন করেছিল র্যাব। চোখ বেঁধে, হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে পিটিয়েছিল তাকে। ১০/১১ বছর আগের ঘটনা। সে মারের দাগ এখনো তার শরীরে রয়ে গেছে।

দেশজুড়ে ভুক্তভোগীরা নিয়মিত নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনা করেন গুম বিষয়ক তদন্ত কমিশনের কাছে (চিত্রটি প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের বর্ণনার উপর ভিত্তি করে আঁকা)
এমন মার শুধু এজন্যই মেরেছিল যেন সে স্বীকারোক্তি দেয় যে, সে অমুক সংগঠন করত। কিন্তু সে স্বীকারোক্তি দেয়নি। তাই তাকেও উলঙ্গ করে ঝুলিয়ে রাখে। তার গোপনাঙ্গেও বৈদ্যুতিক ক্লিপ লাগিয়ে শক দেয়। এভাবে দুই ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখে তাকে। শুধু স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য।
[৩]
গুম বাহিনী যে শুধু পুরুষদেরকেই গুম করেছে এমন নয়। তারা অনেক নারীকেও গুম করেছে। এক পর্দানশীন মুসলিম যুবতীর ঘটনা তোমরা অনেকেই হয়তো জানো। কোনো গাইর মাহরাম তাকে দেখতে পারত না। একদিন সেও গুমের শিকার হলো। মুসলিমদের ট্যাক্সের টাকায় পেট চালানো গুম বাহিনী তাকে আয়নাঘরে বন্দি রাখে। নানা অপমানজনক কথা শুনিয়ে তাকে কষ্ট দেয়।
একদিন তাকে অনেকটা ক্রুশের মতো হাত দুই দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখে। এরপর তার ওড়না নিয়ে নেয় জানোয়ারের দল। বোনটির গায়ে ওড়না ছিল না। কত পুরুষ সদস্য যে তাকে এই অবস্থায় দেখেছে বলার বাইরে। আর এতে গুম বাহিনী মজা নিচ্ছিল। একজন আরেকজনের উদ্দেশ্যে বলাবলি করছিল, “এমন পর্দাই করছে, এখন সব পর্দা ছুটে গেসে।”
এটাই শেষ নয়। র্যাবের এক কুখ্যাত কর্মকর্তা আলেপ উদ্দিন। সে অনেক মানুষকে গুম ও খুন করেছে। একবার এক ভিকটিমকে গুম করে রাখার সময় তার স্ত্রীকে রোজা ভাঙিয়ে সম্মানহানি করে আলেপ। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!
আমাদের খেয়ে আমাদের পরে আমাদেরই ভাইদের গুম-খুন করেছে, বোনদের সম্মানহানি করেছে সরকারি এই বাহিনীগুলো। আয়নাঘরের জঘন্য খিনজিরের দল।
আর কোনো আয়নাঘর চাই না
এই ছিল আওয়ামী জাহিলিয়াতের ‘আয়নাঘর’। যেখানে মানবতা ডুকরে ডুকরে কাঁদত। যেখানে মধ্যযুগীয় বর্বরতার মেলা বসত গণতন্ত্র আর সেক্যুলারিজমের দোহাই দিয়ে। সত্যি বলতে, আয়নাঘর ছিল সেক্যুলারিজমের অবধারিত ফলাফল।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মুসলিমদের ট্যাক্সের টাকায় এসব আয়নাঘর গড়ে তুলেছিল সেক্যুলার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এমন আয়নাঘর আবারও চাই কিনা? যদি না চাই, তবে আজীবনের জন্য সেক্যুলারিজমের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। আপন করে নিতে হবে সাত আসমানের ওপর থেকে নাযিলকৃত ওহীর জীবনব্যবস্থাকে। সেটা আমরা পারব তো?