এই ছবিটা আমার বিয়ের দিনের। আমার ভাই আকাশ, আর আকাশের বেস্টফ্রেন্ড, আমার আরেকটা ভাই জাহিদ - দুইজনে উৎসকে কোলে তুলে বিয়ের গেইট থেকে স্টেজে নিয়ে আসছে।

আপনি এই ছবিতে কী দেখতে পাচ্ছেন? অনেক হাসি, আনন্দ, উৎসব, মজার একটা মুহূর্ত। কিছুদিন আগ পর্যন্ত আমিও তাই দেখতাম। এখন আমি কী দেখি জানেন? রক্ত, লাশ, যন্ত্রণা, আহাজারি, কষ্ট… 

কারণ এই ছবিতে আমার একটা ভাই আছে, আরেকটা ভাই নাই। চিরদিনের জন্য নাই। একদিন হয়তো এই স্বৈরাচারী শাসকের পতন হবে, একদিন হয়তো আবার দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে চলাচল করবে, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিবে। একদিন হয়তো বিচার হবে, রক্তের দাম দিতে হবে এই অত্যাচারীদের। কিন্তু শত আন্দোলন, বিচার, স্বাধীনতা, শাস্তি - কোনো কিছুর বিনিময়েই আর আমার ভাই ফিরে আসবে না। জাহিদের আব্বু, আম্মু, বোন, ওর বন্ধুরা, ওর কাছের মানুষজন, আমরা কেউ আর কোনোদিন ওর চেহারা, ওর হাসি, ওর আনন্দ দেখতে পাব না।

২৬ বছরের একটা ছেলের লাশ কাঁধে করে নিয়ে যেতে হয়েছে ওর আব্বুকে। ঠিক কতটা ভারী হয় নিজের ছেলের লাশ একজন বাবার কাঁধে? ওর আম্মুকে নিজের একমাত্র ছেলের কবর দেখতে হয়েছে। ঠিক কতখানি কষ্ট হয় একজন মায়ের এটা দেখতে যে, তার ছেলে কবরে শুয়ে আছে? ওর বোন আমেরিকায় আটকা পড়েছে। নিজের একমাত্র ভাইয়ের লাশও শেষবারের মতো দেখতে পায়নি। গত ৩/৪ দিন ধরে তো বাসায় কথাও বলতে পারেনি। জানে না এই কঠিন মুহূর্তে ওর বাবা-মা কেমন আছে, কী করছে, কীভাবে এই কষ্ট সহ্য করছে? আমাকে ওর বোন বারবার বলছে, “আপু, ওকে মারতো, হাত-পা ভেঙ্গে দিত, মেরে ফেললো কেন? কত কষ্ট পেয়ে মরসে আমার ভাইটা! এখন আমার সোনার টুকরা ভাইটাকে ছাড়া আমি কীভাবে বাঁচব?” আমি চুপ করে থাকি, কারণ এর কোনো উত্তর নেই। কেউ জানে না এই প্রশ্নের উত্তর।

আমার ভাই নিজের বেস্টফ্রেন্ডের লাশ নিয়ে এসেছে হাসপাতাল থেকে। জাহিদের কাফনের কাপড় দুইবার চেঞ্জ করতে হয়েছে, কারণ রক্তে ভেসে যাচ্ছিল কাপড়। আমি জানি না আমার ভাই আর কোনোদিন স্বাভাবিক হতে পারবে কি না। জাহিদের বাবা-মা, বোন আর কোনোদিন আনন্দ করতে পারবে না। ওরা কোনোদিন আর জাহিদের পছন্দের কিছু খেতে পারবে না। আমি আর কোনোদিন এইসব ছবির দিকে তাকাতে পারব না। আমি সেইদিন থেকে যতবার ঘুমিয়েছি, স্বপ্ন দেখেছি যে আমাকে আকাশ বলছে, “আপু, জাহিদ মারা গেছে।” নাহলে জাহিদ আমাকে বলছে, “আপু, আকাশ মারা গেছে।” ওদের বন্ধুরা কি কোনোদিন আর ওদের ভার্সিটি লাইফের স্মৃতির কথা মনে করতে পারবে?

এই আন্দোলন, এই স্বাধীনতা, এই কোটা দিয়ে কী করবে এখন জাহিদের বাবা-মা? সব কোটা, সব চাকরি, সবকিছু নিয়ে যাক, শুধু আন্টির কোলে উনার ছেলেকে ফিরিয়ে দিক কেউ। কিন্তু পারবে না। কোনো কিছুর বিনিময়েই আর পারবে না ওকে ওর মা-বোনের কাছে ফিরিয়ে আনতে।

আজকে অলরেডি যারা ইনিয়েবিনিয়ে “কোটা তো সংস্কার হয়েছে... “, “আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করি... “, “জনজীবন বিচল হয়ে আছে…”, “সঠিক সমাধান দরকার…”, “আমরা এইটাকে পলিটিকাল না বানাই…”, “সব ঠিক আছে, কিন্তু… ”, “তবুও…”, “তারপরেও…”  - এসব বলা শুরু করেছেন, তাদের শুধু একটাই কথা বলার আছে, আপনাদের মুখে থুথু। মৃত্যুর সময় যেন আপনাদের মুখে কেউ পানিও না দেয়।

আমাদের একমাত্র সান্ত্বনা কী জানেন? আমার ভাই শহীদের মর্যাদা পাবে, ওর বাবা-মাকে ও হাত ধরে জান্নাতে নিয়ে যাবে। কিন্তু আপনারা যারা জাহিদের মৃত্যুর জন্য দায়ী, তারা অনন্তকাল ধরে হাবিয়া দোজখের আগুনে পুড়বেন। আপনাদের এত ক্ষমতা, টাকা, অস্ত্র কোনোকিছুই আর সেইদিন কাজে আসবে না। যে কয়দিন পারেন, এই দুনিয়ায় আরাম করে নেন। কারণ এর পরের জগতে অনন্তকালের জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য; যেই শাস্তির কোনো শেষ হবে না। কোনোদিন না!

[২২ জুলাই, ২০২৪ তারিখে লিখিত। ঈষৎ পরিমার্জিত। লেখিকা শহীদ জাহিদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বড় বোন।]