৫ই আগস্ট মেহেদির মা ফজর নামাজ পড়ে কুরআন শরীফ পড়তেছেন। তিনি শুনতে পান ড্রয়িংরুম থেকে টিভির শব্দ শোনা যাচ্ছে। উনি গিয়ে দেখেন, মেহেদি বিভিন্ন চ্যানেল পাল্টিয়ে খবর দেখতেছে। মা বলেন, ‘এত ভোরে টিভি না দেখে ঘুমাও কিছুক্ষণ, বাবা।’ মেহেদি মাকে বলে, ‘ঘুমাব না, আম্মু।’ মা তখন বলেন, ‘কিছু খাবে? রেডি করে দিব?’ মেহেদি মাথা নাড়িয়ে না-বোধক উত্তর দেয়। আম্মু রোজা রাখছি, কিছুক্ষণ ঘুমাই—এ কথা বলে মা তখন ঘুমাতে চলে যায়। মেহেদির বাবা তখন ফজর পড়ে হাঁটতে বের হয়েছিল।
কিছুক্ষণ পর বাসায় ফিরে বাবা মেহেদিকে বলেন, ‘যাও বাইরে থেকে নাস্তা নিয়ে আসো।’ মেহেদি বলে, ‘আজকে সকালে নাস্তা করব না। মা’র হাতে রসুনভর্তা দিয়ে ভাত খাব।’ মা বলে, ‘শুধু রসুনভর্তা? সাথে ডিম ভেজে দিই?’ (মায়ের হাতে রসুনভর্তা তার খুব পছন্দের ছিল)
মায়ের হাতে ভাত খেতে খেতে মেহেদি বলে, ‘আম্মু, তোমার কাছে একটা বিষয় লুকাইছি।’ মা কৌতুহলী হয়ে জানতে চায়, ‘কী লুকাইছো!’ মেহেদি হাসতে হাসতে বলে, ‘আমি তোমাকে না জানিয়ে লুকিয়ে ২ দিন আন্দোলনে গেছি। রাস্তায় ভাইয়াদের পানি-বিস্কুট খাওয়াইছি।’
মেহেদি খেতে খেতে মাকে বুঝায়, ‘আমাদের বয়সী কতজন রাস্তায় নামছে। মার খাচ্ছে। প্রতিবন্ধী ছেলেরা পর্যন্ত রাস্তায় নামতেছে, আমরা কীভাবে ঘরে বসে থাকি। বড় ভাইয়ারা তো আমাদের সবার অধিকারের জন্যই জীবন দিচ্ছে।’
ছেলের কথায় মন গলে মায়ের। মা তখন বলেন, ‘আজকে আমরা সবাই বের হব।’ বড়বোন, মা এবং মেহেদি একসাথে বের হওয়ার পরিকল্পনা করে। মেহেদির বড়বোনের কলেজ থেকে জানতে পারে সেখানে স্টুডেন্টরা অভিভাবকদেরও আহ্বান করছে যেতে। তারা পরিকল্পনা করে সেখানে যাবেন। এরমধ্যে মা বোরকা পরছেন, মেহেদি বলে, ‘মা, একটু অপেক্ষা করো, আমার এক বন্ধু আছে, ওকে নিয়ে আসি। আমরা একসাথে যাব।’ মা বলেন, ‘ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি আইসো।’
এইদিকে মেহেদির মা-বোন যখন রেডি হচ্ছিল বের হতে, তখন ওর বাবা বকাঝকা করতে থাকে। ‘আজকে ঢাকার পরিস্থিতি ভালো হবে না। তোরা ভুলেও বের হইছ না।’ মেহেদির মা বোরকা পরতে পরতে বলে, ‘আল্লাহ কপালে যা রাখছে তা-ই হবে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা মার খাবে, আমরা ঘরে বসে থাকব কীভাবে!’
এরমধ্যে মা-মেয়ে রেডি হয়ে মেহেদির জন্য অপেক্ষা করে, কিন্তু মেহেদির ফেরার কোনো লক্ষণ নাই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মা বলে, ‘আচ্ছা থাক, ও মনে হয় বন্ধুকে আনতে গিয়ে খেলতে চলে গেছে (প্রতিদিন এ সময় বন্ধুদের সাথে ধুপখোলা মাঠে খেলতে যায়)। আমরা দু'জন বের হয়ে যাই।’ মা-মেয়ে চলে যায় মেয়ের কলেজ মতিঝিল আইডিয়ালের সামনে। এদিকে মেহেদি বন্ধুূের সাথে চলে যায় চাঁনখারপুল, আন্দোলনের ফ্রন্টলাইনে।
মোড়ে মোড়ে পুলিশ জিজ্ঞেস করছিল, ‘কই যাচ্ছেন?’ মেহেদির মা প্রতিবারই উত্তর দিছেন, ‘লাশ দেখতে যাচ্ছি। আমার নিকটাত্মীয় একজনের লাশ।’ তিনি তখনো জানতেন না, তাকে ঘরে ফিরতে হবে ছেলের লাশের খবর পেয়ে। ঘরে ফিরে তাকে সত্যিই লাশ দেখতে হবে।
মেয়েকে নিয়ে বারোটার আগেই আইডিয়াল কলেজের সামনে পৌঁছে যান। উনাকে দেখে, একজন শিক্ষার্থী মাইকে বলছিল, আমাদের একজন মা চলে এসেছেন মেয়েকে সাথে নিয়ে। এভাবে আমাদের সব মায়েরা আমাদের সাথে থাকলে আমরা সাহস পাব।
এরমধ্যে প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। মায়ের মনটা কেমন যেন ছটফট করছে। পাশে থাকা মেয়ে বলে, ‘আম্মু তুমি রোজা রাখছো, আর রোদ তো, এজন্য খারাপ লাগছে। দেখবা ঠিক হয়ে যাবে।’ উনি তখন উত্তর দেন, ‘না রে। আমার বুকটা ধুকধুক করছে। ভালো লাগতেছে না। এটা রোজা রাখার জন্য না। আমার মেহেদির কিছু হলো কিনা, আল্লাহ মাবুদ জানে।’ এরমধ্যে মেয়েকে একটু বকাও দেন, ‘তোমার ফোনে ২টা সিম, একটা সিম তো ওর ফোনে রাখলে এখন খোঁজ-খবর নিতে পারতাম।’ মেয়ে তখন বলেন, ‘ওর ফোনে সিম রেখে কী হবে, মাঝেমধ্যে একটু গেমস খেলা ছাড়া ও তো কারও সাথে কথাবার্তা বলে না।’
আন্দোলনেই তাদের সময় কাটে। কিছুক্ষণ পর ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখেন প্রায় ১৫-১৬টা কল, সব তার বাপের বাড়ির আত্নীয়স্বজনের। মেহেদির মা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মনে বড় ভাইয়ের কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে ওঠে, ‘মোস্তাকিম কই?’ (এখানে বলে রাখি, মেহেদির ডাকনাম মোস্তাকিম। তার মা আদর করে এ নাম দিয়েছিলেন। এটা তার সার্টিফিকেটে নাই।)
উত্তর দেন, ‘বাসায়।’
‘তুই শিউর, ও বাসায় আছে?’
‘এ সময় তো ঘরেই থাকে।’
‘তাড়াতাড়ি ওর খোঁজ নে।’
এভাবে বিভিন্ন জায়গা থেকে কল আসতে থাকে মেহেদির মায়ের কাছে। কেউ তখনো বলেনি সে মারা গেছে। বলছে, মাথায় আঘাত পেয়েছে, তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে। ততক্ষণে মায়ের মনের ভেতর পুরোপুরিভাবে খবর হয়ে গেল তার কলিজার টুকরার কিছু একটা হয়ে গেছে।
মেয়েকে নিয়ে আইডিয়াল কলেজের আন্দোলন থেকে দ্রুত বাসায় ফেরেন। বাসার কাছাকাছি এসে দেখেন, তাদের বাসার সামনে পুকুরপাড়ে শতশত মানুষ, কেউ কান্নাকাটি করতেছে। উনি সবাইকে ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখেন, তার ছেলের নিথর দেহটা পড়ে আছে৷ ঐ মুহূর্তে তার সারা শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়। সেন্সলেস হয়ে পড়েন।
ফিরে আসা যাক চাঁনখারপুলে, সেদিন কীভাবে শহীদ হয়েছিল শেখ মেহেদি হাসান জুনায়েদ।
এগারোটার দিকে মেহেদি তার বন্ধুদের সাথে চাঁনখারপুল আন্দোলনের ফ্রন্টলাইনে চলে যায়। দেড়-দুই ঘণ্টা সেখানে পুলিশের সাথে তারা ফাইট করে। পুলিশের গুলির বিপরীতে প্রতিরোধ হামলা চলে ইটপাটকেল ছুঁড়ে। মেহেদি এবং তার বন্ধুরা ছিল বড়দের সাথে একদম সামনে। একটার দিকে তার এক বন্ধু বলে, ‘দোস্ত, চল্ আমরা বাসায় চলে যাই।’
মেহেদি উত্তর দেয়, ‘তুই যাইলে যা, আমি যাব না। হয় শহীদ হয়ে ঘরে ফিরব, না হয় তার (হাসিনার) পতন শেষে বীরের বেশে ঘরে ফিরব।’
মেহেদির এক বন্ধু তখন বাসায় চলে যায়, আরেক বন্ধু তার সাথে থেকে যায়। আনুমানিক দেড়টার দিকে, ওদের মিছিল যখন একটু সামনে আগায় তখন ব্যাকফুটে যায় সামনের পুলিশের দল। তখন পাশে একটা গলির মুখে অবস্থান করছিল কিছু পুলিশ। মেহেদি মাথা নিচু করে ইটের টুকরা হাতে নিতে যাবে, ঠিক তখনি পরপর দুইটা গুলি তার মাথায় আঘাত করে। একটা গুলি একপাশে দিয়ে ঢুকে ছিদ্র করে আরেকপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। আরেকটা গুলি তার চোখ দিয়ে ঢুকে ভেতরে আটকে যায়।
মেহেদিকে মানুষজন উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যায়। রক্তাক্ত মেহেদিকে ঢাকা মেডিকেল নেওয়া হলে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলেন, “উপর থেকে নির্দেশ দিয়েছে চিকিৎসার জন্য কাউকে রিসিভ করা যাবে না। অন্য কোথাও নিয়ে যান, নাহয় লাশের সাথে মর্গে ফেলে রাখেন, পরিবার আইস্যা খুঁজে নিয়ে যাবে।”
পরে সেখান থেকে মেহেদিকে মিটফোর্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে সে আর বেঁচে রইল না। শহীদের খাতায় তার নাম যোগ হয়ে যায়।
ঐখানের মানুষজন মেহেদির পকেটে থাকা সিম ছাড়া স্মার্টফোনটাতে ডায়াল কলে দেখেন, বাবা নামে একটা নম্বর সেইভ করা। মানুষজন মনে করছিল, বোধহয় তার বাবা হতে পারে। কিন্তু কল দিলে তার নানা ধরেন। মেহেদির মা তার বাবার (মানে মেহেদির নানা) নম্বর বাবা নামে সেইভ করেছিলেন। এই ফোনটা তার মা চালাতো।
তাদেরকে কল দিয়ে মেহেদির খবর জানানো হয়। সেখান থেকে আত্নীয়স্বজন সবার জানাজানি হয়। তার মা তখনো মেয়েকে নিয়ে রাজপথে আন্দোলনে। মেহেদির নিথর দেহ বাসায় আনার এক ঘণ্টা পর তিনি বাসায় এসে পৌঁছান।
মেহেদির বয়স মাত্র ১৪ বছর। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে, একইসাথে কুরআনে হাফেজ হবে। এজন্য হাফেজি মাদরাসায় ভর্তিও হয়েছিল। প্রায় ১০ পারার মতো মুখস্থ করে ফেলছে। নম্র-ভদ্র ছেলে হিসেবে এলাকার সবাই তাকে ভালোবাসত। তার মা জানায়, মেহেদির জানাযায় এত মানুষ হয়েছে যে, এখানে কেন্দ্রীয় ঈদের জামাতেও এত মানুষ হয়নি কখনো।
কয়েক মাস আগে এলাকার মসজিদে ঘোষণা করেছিল, যারা ৪০ দিন জামাতে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে, তাদের সাইকেল দেওয়া হবে। মেহেদি সেখান থেকে অনেক বড় একটা সাইকেল পেয়েছিল। ওর মা বলছিল, এতবড় সাইকেল তুমি কী করবে? ও তখন বলে, কয়দিন পর আমি পড়তে চলে গেলে আব্বু চালাবে আমার সাইকেল।
কোনো কারণে বাবা তাকে মাঝেমধ্যে বকাঝকা করলে বাবার অনুপস্থিতিতে মাকে সে সময় বলত, ‘দেখো আম্মু, আব্বু এখন আমাদের বকাঝকা করে। একদিন দেখবা আমাদের দুই ভাই-বোনকে নিয়ে তোমরা গর্ববোধ করবা।’ মা তাকে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার আপু ভালো ছাত্রী। এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে, ওকে নিয়ে নাহয় আশা করা যায় ভবিষ্যতে কিছু করতে পারবে। কিন্তু তুমি এমন কী করছো বা করবা যে তোমাকে নিয়ে আমরা গর্ববোধ করব?’
মেহেদি তখন বলে ওঠে, ‘আরে দেইখো, এখন নাহয় কিছু করতে পারি নাই। একদিন দেখবা আমাকে নিয়েই বেশি গর্ববোধ করবা।’
মেহেদি সত্যিই বাবা-মাকে গর্ববোধ করতে পেরেছে। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মিত হয়েছে তারমতো কিশোরদের রক্তের উপর দিয়ে। তার মা-বাবার জন্য এটা পরম গৌরবের।
একজন সন্তানহারা মায়ের কথা একনাগাড়ে শুনে গেলাম। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো শব্দ আমার জানা ছিল না। সর্বশেষ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আড়াই মাস ধরে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে যাই। রাতে ঘুম ভেঙে যায়, ছেলের কথা মনে পড়ে। কাঁদতে থাকি। তার প্রিয় খাবার রসুনভর্তা তৈরি করে রাখি, কিন্তু আমার মোস্তাকিম (মেহেদি) খেতে আসে না। তার বিড়ালগুলো তাকে খুব মিস করে। তার রুমে ঘুরাঘুরি করে। তার ছবির পোস্টারের ওপর শুয়ে থাকে, তাকে খোঁজে। শোকেসভর্তি ক্রেস্টগুলো দেখি। কানে বাজে তার কথা, “আম্মু দেখবা, আমাকে নিয়ে তোমরা একদিন অনেক গর্ব করবা।”’