সময় মতো ড্রাইভারকে না পেয়ে আয়ানের কপালটা কুঁচকে আছে। ড্রাইভারকে নিচে না পেয়ে ডাকার জন্য ছাদে গেল সে। কাজ ফেলে বউয়ের সাথে সময় কাটাচ্ছে, ভাবতেই মেজাজটা বেশ খারাপ হলো আয়ানের। হাশেম ভাই প্রায় ছয় বছর যাবৎ তাদের বাসায় ড্রাইভারের কাজ করে। আগে উনি ডাকার আগেই হাজির থাকত। আজকাল উনাকে সার্চলাইট দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না। এক বছর হলো হাশেম ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে তাদের গ্রামেরই এক মেয়ের সাথে। কিছুদিন আগে বউকে ঢাকায় এনেছে। তার নাকি বাচ্চা হবে। এখন একটু সুযোগ পেলেই হাশেম ভাই বউয়ের কাছে ছুট লাগায়।

ছাদের একটা চিলেকোঠা ঘরে হাশেম ভাই থাকে। আয়ানদের বাসা থেকেই দু বেলা খাবারটা খেয়ে নিত। ছাদে উঠে অবশ্য আয়ান দেখতে পেল ছোটখাটো সংসার বসে গেছে। বাইরের তারে নানান কাপড়চোপড় মেলা। রান্নাঘর নেই বলে ছাদের এক কোণেই ইট-লাকড়ি দিয়ে চুলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একজন কমবয়সী মেয়ে সেখানে বসে রান্নাবান্না করছে। আয়ান উপরে এসে ‘হাশেম ভাই’ বলে ডাক দিতেই মেয়েটা তড়িঘড়ি করে মাথায় ঘোমটা টেনে নিল। আয়ানের ডাক শুনে ভেতর থেকে হাশেম বের হয়ে আসে। তার কপাল বেয়েও ঘাম ঝরছে। আয়ানকে দেখে একটু লজ্জা পেল হাশেম। ছুটোভাই, আমি অহনই আইতাছি। আপনার ভাবির শরীরডা অত ভালো না, তাই ঘরের কাম একটু আগায় দিতে আসছিলাম।

‘আচ্ছা, জলদি আসবেন।’ বলেই দ্রুত পায়ে হনহন করে নিচে নেমে যায় আয়ান।

কলেজে ওর একটা কনসার্ট আছে। কনসার্টের মূল আকর্ষণ আয়ান নিজেই। আয়ান ওর কলেজের মধ্যমণি৷ দি আইকনিক নামে ওর একটা গানের পেইজ আছে। সেখানে ও মাঝে মাঝেই গান গেয়ে আপলোড দেয়। এরপর থেকে ওর নামই হয়ে গেছে আইকনিক। কেউ ওর আসল নাম না জানলেও এই নামে সবাই চেনে। কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন হলেই ওকে নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়।

আজ একটা সাদামাটা বাংলা গানই গাইবে, তবে ওর পছন্দ হেভি মেটাল। সারাদিন বাসায় জোরে রক মিউজিক ছেড়ে রাখে আয়ান। ওর মা রাহেলা বেগম আগে খুব রাগারাগি করতেন। তিনি নামাজী, পরহেজগার মহিলা। খুব ইচ্ছা ছিল একমাত্র ছেলেকে মাদরাসায় পড়াবেন। কিন্তু স্বামীর সহযোগিতা পাননি। বাপের প্রশ্রয়ে ছেলে গান-বাজনা নিয়ে মেতেছে, নিজের ব্যান্ড খুলেছে। ছেলেকে মানাতে না পেরে ইদানীং হাল ছেড়ে দিয়েছেন রাহেলা।

নিচে নামার কিছুক্ষণের মাঝেই হাশেম ভাই চলে আসে। গাড়ি চালাতে চালাতেও নিজের অনাগত সন্তানের কথা তোলে,

‘ভাইজান, ঠিক করসি বিড়িটা ছাইড়া দিমু। বাচ্চার জন্য এইটা ভালো না।’

‘তাই। পুরাপুরি ছাড়বেন?’

‘হ, ভাই। আর খামু না। বিড়ির ধুয়ায় বাচ্চার রোগবালাই হয়।’

হাশেম ভাইয়ের কথা শুনে আয়ানের হাসি পায়।

‘ভাইজান, আইজ কি আপনার কনসাট আছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কয়টা গান গাইবেন ভাইজান?’

‘তিন-চারটা তো গাইতেই হবে।’

কিছু একটা বলাই লাগে, তাই আয়ানও টুকটাক প্রশ্ন করে। ‘বাচ্চার নাম ঠিক করসেন, হাশেম ভাই?’

বাচ্চার কথা শুনে হাশেম আপনমনে হাসে।

‘জি না, ভাইজান। ডাক্তার আপায় কইসে আর দুই মাস গেলে পরে জানুম বাচ্চা পোলা না মাইয়া, এরপর একখান নাম ঠিক করুম ইনশাআল্লাহ।’

‘আচ্ছা। তা ছেলে চান না মেয়ে?’

‘আল্লাহ যা দেয় তাইতেই খুশি, ভাইজান। একখান সুস্থ বাচ্চা হইলেই আলহামদুলিল্লাহ।’ হাশেমের চোখেমুখে খুশির আভা।

আয়ানের বাসায় ফিরতে রাত হয়। সারাদিন নাচ-গান করে ক্লান্ত শরীরে ঘুম আসতে দেরি হয় না। পরদিন দেখে সাউন্ডবক্সটা কাজ করছে না। গতকাল যাওয়ার আগেও ঠিক ছিল৷ এখন কী হলো? কয়েক বার চেষ্টা করেও কূল-কিনারা খুঁজে পেল না সে। এই সাউন্ডবক্সগুলো দেশের বাইরে থেকে ওর বড় দুলাভাই পাঠিয়েছে। এই জিনিস ঠিক করার মতো লোক এ দেশে পাওয়া যাবে না। বিরক্তিতে ছেয়ে গেল ওর মুখ। ভালো সাউন্ডবক্স থাকাটা ওর কাছে ঘুম কিংবা খাবারের চেয়েও জরুরি। না খেয়ে, না ঘুমিয়েও ও থাকতে পারবে। কিন্তু জোরে হেভি মেটাল না শুনলে ওর ঘুম হবে না।

আয়ান তখনই ওর বড় বোনকে ফোন দিলো। আয়ানের ফোন পেয়ে ওর বোন যারপরনাই বিস্মিত, ‘কীরে আয়ান, তোকে তো খুঁজেই পাই না। আজকে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি?’

‘আহ, আপু, তুমি জানোই তো আমি বিজি থাকি। অহনা কেমন আছে?’ 

অহনা আয়ানের বোনের মেয়ে। দুই-চার কথা সেরে আয়ান ওর বোনকে জানাল আগের সাউন্ডবক্সটা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আপু তেমন একটা আগ্রহ দেখাল না। 

‘আয়ান, তুই জানিসই তো, আমরা মাত্রই এই বাসাটা কিনেছি। এখন বাসাবাড়ির অনেক ঝামেলা। ফ্লোর বসাতে হবে, পেইন্টিং করতে হবে। অহনার জন্য এই এরিয়াতে নতুন নার্সারি খুঁজতে হবে। তোর দুলাভাইয়ের একদম মাথা খারাপ দশা। কয়টা দিন পরে আমিই তোকে কিনে পাঠাব, কেমন? এখন কোনোমতেই পসিবল না৷’

আয়ানের মেজাজটা খুব খারাপ হলো। সাউন্ডবক্সটা ওর কতটা প্রয়োজন কেউ বুঝতেই চায় না। ও ঠিক করল, আপুকে আর বলবে না। দেশেই ভালো সাউন্ডবক্সের সন্ধান করবে।

যতগুলো গানের পেইজ চিনত সবখানে পোস্ট দিয়ে দিলো। সাউন্ডবক্স নেই কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেছে৷ আর দু দিন পরেই নিউ ইয়ার। এভাবে সাউন্ডবক্স ছাড়া নিউ ইয়ারের কথা ও কল্পনাও করতে পারে না। দরকার হলে একটু দাম দিয়ে হলেও একটা ভালো সাউন্ড সিস্টেম কিনবে বলে ঠিক করল। 

পেইজে পোস্ট দেওয়ায় কাজ হয়েছে। বেশ কয়েকজন ওকে মেসেজ করেছে। এর মধ্যে এক লোকের কাছে বিদেশি সাউন্ডবক্স আছে। তিনি মেয়ের জন্য শখ করে আনিয়েছেন, কিন্তু মেয়ে স্টুডেন্ট ভিসায় বিদেশ চলে গেছে। সাউন্ডবক্সগুলো কমের মধ্যেই সেল করে দিতে চাচ্ছেন। আয়ান যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। 

দুপুরে লোকটার মেসেজ পেয়েছিল, সন্ধ্যার মধ্যেই সাউন্ডবক্সগুলো কিনে ফেলল। বাসায় ফিরে জায়গামতো লাগিয়ে চেক করে দেখল সব ঠিকঠাক আছে। লোকটা মিথ্যা বলেনি, জিনিসগুলো দারুণ কাজের! আওয়াজটা আগেরগুলোর চেয়েও জোরালো। খুব পাওয়ারফুল সাউন্ডবক্স। মিউজিক ছাড়লে মনে হয় দ্রিম দ্রিম করে বাসাটা বাজছে। অনেকদিন পর গান শুনে আয়ানের শান্তি লাগল।

নিউ ইয়ার ইভে বন্ধুরা সব আয়ানের বাসায় ভিড় করে। একে তো এটা আয়ানদের নিজেদের বাড়ি। তার উপর ওর বাবার কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তিনি নিজেও সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ। রাতভর ছাদে আড্ডা মারে ওরা।

সন্ধ্যা লাগতেই আয়ানের বন্ধুবান্ধব এক এক করে আসতে শুরু করল। আয়ান সাউন্ডবক্সগুলো ছাদে সেট করল। আজ সবাই এখানেই গানবাজনা করবে। ওর মা নামাজ-কালাম সেরে আগেভাগেই নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছেন। এত গানবাজনার শব্দ উনি সহ্য করতে পারেন না। আয়ানের বাবা আজ বাসায় নেই। বিজনেসের কাজে অন্য শহরে গেছেন।

‘জিনিসটা জোস!’

‘কই পাইলি?’

‘কত নিলো?’

বন্ধুরা আয়ানের সাউন্ডবক্স দেখে উচ্ছ্বসিত। একেকজন একেকটা মন্তব্য করছে। এমন একটা জিনিস কিনতে পেরে আয়ানেরও খুব গর্ব হচ্ছে।

যত রাত হয় ওদের হৈ-হুল্লোড় যেন বাড়তে থাকে। নতুন সাউন্ডবক্সের তীব্র শব্দে কান পাতা দায়। মনে হচ্ছে হেভি মেটাল মিউজিকে দেয়ালগুলো ভেঙে পড়বে। ছাদটা আওয়াজের তালে তালে নাচছে।

সবাই খুব এনজয় করছে। শুধু একজন বাদে। হাশেমের স্ত্রী ময়না এই তীব্র আওয়াজ সহ্য করতে পারছে না। তার স্বামী আজ বাসায় নাই। বড় স্যারকে আনতে ঢাকার বাইরে গেছে। কখন আসবে কোনো ঠিক নাই।

রাত দুইটা বাজে। এখনো হাশেম আসার কোনো খবর নাই। কিছুক্ষণ আগে ময়না হাশেমকে ফোন দিয়েছে। হাশেম বলল, ‘আসতে আরও আট ঘণ্টা লাগবে। রাস্তায় অনেক জ্যাম।’

ময়না সারারাত এপাশ-ওপাশ করে, ব্যথার যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে। ‘আল্লাহ গো, এরা কি মানুষ না আর কিছু!’ 

এত জোরে কোনোদিন কোনো আওয়াজ শুনে নাই গ্রামের মেয়ে ময়না। আওয়াজের তীব্রতায় ওর শরীরের কোষগুলো বিদ্রোহ করে। ছোট্ট জানটা কখন বের হয়ে যায় টের পায় না কেউ। ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে আসে ময়নার। ঘুম থেকে উঠে দেখে ও রক্তের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। ভয়ে চিৎকার করে জ্ঞান হারায়। আয়ানের বন্ধুবান্ধব চিৎকার শুনে হাশেমের চিলেকোঠা ঘরে উঁকি মারে। ময়নাকে অচেতন দেখে আয়ান দ্রুত ওর মা'কে ডাক দেয়।

রাহেলা ছাদে এসে ময়নার মুখে পানি ছিটান। আয়ানকে বলেন, ক্যাব ডাকতে। ততক্ষণে ময়নার হুঁশ ফিরেছে। সারা রাস্তায় মেয়েটা ব্যথায় গোঙাতে থাকে। বারবার বলে, ‘ও আল্লাগো, বাজ পড়তাছে! বাজ পড়তাছে!’ হাসপাতালে ভর্তি করার কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বলে, মেয়েটা শকে আছে। খুব লাউড সাউন্ডে ভয় পেয়েছে। নিউ ইয়ার ইভে মেইবি আপনাদের বাসার আশেপাশে কেউ বাজ ফুটিয়েছে। বাচ্চাটা যতসম্ভব মিসক্যারেজ হয়ে গেছে।

রাহেলা চোখমুখ শক্ত করে আয়ানের দিকে তাকান। উনাদের বাসার কাছে কেউ বাজ ফোটায়নি। বরং সারারাত ধরে তারই সন্তানের গানবাজনা বাজানোর কারণে আজ আরেকজনের সন্তানের এই অবস্থা। আয়ান ডাক্তারের কথা শুনে তাজ্জব হয়ে যায়। ও কখনো কারও ক্ষতির কারণ হবে, এটা ওর কল্পনাতেও আসেনি।

ওর চোখে হাশেম ভাইয়ের হাসি হাসি মুখটা ভাসছে, ‘আল্লাহ একটা সুস্থ সন্তান দিলেই আমরা খুশি, ভাইজান!’

এই লোকটার সামনে কীভাবে দাঁড়াবে আয়ান?

ও কি একটা জালেম?

ও কি খুনি?

সারাজীবন নামাজ-কালাম না পড়া ছেলেটা শার্টের হাতা গুটিয়ে হাসপাতালের টয়লেটেই ওযু সেরে নেয়। জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে দুআ করে, ‘হে আল্লাহ, তুমি হাশেম ভাইয়ের বাচ্চাটাকে নিয়ো না! বাচ্চাটাকে বাঁচায় রেখো!’ ওর চোখ বেয়ে দরদর করে পানি পড়ে।

কয়েক ঘণ্টা পর হাশেম হাসপাতালে আসে। তার চোখমুখ মলিন হয়ে আছে। আয়ানের দিকে তাকাতে পারে না হাশেম। বউয়ের কষ্টের কারণটা সে ভালোভাবেই জানে।

আয়ান এগিয়ে এসে হাশেম ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখে, সব ঠিক হয়ে যাবে হাশেম ভাই। আমি ঠিক করেছি, এরপর থেকে আর গানবাজনা করব না। হাশেম এবার আয়ানের দিকে তাকায়, ওকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।

কয়েক ঘণ্টা পর ডাক্তার এসে জানায়, ‘ইটস এ মিরাকল! মা-বাচ্চা দুজনেই সুস্থ আছে। অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। উনাকে বাড়িতে নিয়ে প্রচুর রেস্ট দিন। ভালো ভালো পুষ্টিকর খাবার খাওয়ান।’

খুশিতে আয়ানের চোখ ভিজে যায়। ও ওর কথা রাখবে। মনে মনে উচ্চারণ করে, ‘থ্যাংকস আল্লাহ! থ্যাংক ইউ ভেরি ভেরি মাচ।’