চব্বিশের জুলাই-অগাস্টে বাংলাদেশ এক অভূতপূর্ব সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। দেড় দশক ধরে এ দেশের মানুষের ঘাড়ে চেপে বসা রক্তখেকো জালিমের পতন ঘটিয়েছে জনগণ। তিলে তিলে গড়ে তোলা জুলুমের প্রাসাদ গুড়িয়ে দিয়েছে। রৌমারি, পিলখানা, শাপলা, মোদিবিরোধী আন্দোলন, আঠারো ও চব্বিশের কোটা আন্দোলন - পনেরো বছরের জমে থাকা ক্ষোভ বুকে নিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিল ছাত্র-জনতা, বিলিয়ে দিয়েছে হাজারো প্রাণ। এক রক্তবন্যা পেরিয়ে আজ আমরা হাসিনামুক্ত হয়েছি। কিন্তু জুলাইয়ের পরে তোমরা নিশ্চয়ই দেখেছ, কিছু মানুষ জুলাইকে বিপ্লব বলছে, আবার কেউ বলছে অভ্যুত্থান। একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে - জুলাই ‘বিপ্লব’ নাকি ‘অভ্যুত্থান’? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে ইচ্ছে করেনি তোমাদের? জানি, করেছে। চলো, জেনে আসি জুলাই প্রশ্নের উত্তর।
বিপ্লব ও অভ্যুত্থান নিয়ে অসংখ্য গবেষণা হয়েছে, বই লেখা হয়েছে। গভীর পর্যালোচনার পর এই বিষয়গুলোর একটা নির্দিষ্ট সংজ্ঞা ও কিছু বৈশিষ্ট্য দাঁড়িয়েছে। তাই কোনো ঘটনাকে বিপ্লব বা অভ্যুত্থান বলতে হলে আমাদের দেখতে হবে তা ঐ সংজ্ঞা ও বৈশিষ্টের সাথে মিলছে কিনা।
বিপ্লব মানে হলো সমাজ ও রাষ্ট্রে বড় ধরনের পরিবর্তন, যা দ্রুত ঘটে এবং অনেক সময় রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে আসে।[১] এই পরিবর্তনে জনগণের চিন্তাভাবনা, রাজনৈতিক নিয়ম, সামাজিক কাঠামো, নেতৃত্ব ও সরকারের কাজ করার পদ্ধতি সবকিছু বদলে যায়।
বিপ্লব প্রধানত দুই ধরনের: সমাজ বিপ্লব ও রাজনৈতিক বিপ্লব।
সমাজ বিপ্লব ঘটে যখন জনগণ বিদ্রোহ করে সমাজ ও রাষ্ট্রের অবস্থা এবং কাঠামো পুরো বদলে ফেলে।[২] শাসকরা জোর করে নিজের আদর্শ ও নিয়ম জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়, সরকারি বাহিনী দিয়ে বিরোধিতা দমন করে, আর তাদের সমর্থকরা সুবিধা নেয়। জনগণ ভিন্ন এক আদর্শে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শাসককে সরিয়ে নতুন নিয়ম-কানুন ও কাঠামো গড়ে তোলে। এটাই সমাজ বিপ্লব।
রাজনৈতিক বিপ্লব হলো যখন জনতার সমর্থনে জোরপূর্বক ও অনিয়মিতভাবে দেশের শাসনব্যবস্থা বা রেজিম বদলে যায়।[৩] রেজিম মানে শুধু সরকার নয়; এর মধ্যে ক্ষমতায় আসার নিয়ম, রাজনৈতিক চিন্তা, সেনাবাহিনী, প্রভাবশালী গোষ্ঠী, আমলাতন্ত্র ও সুবিধাভোগী শ্রেণি সব অন্তর্ভুক্ত। আর সরকার হলো রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা যার হাতে থাকে।
রাজনৈতিক বিপ্লবের তুলনায় সমাজ বিপ্লবের প্রভাব অনেক বেশি। রাজনৈতিক বিপ্লবে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে। কিন্তু সমাজ বিপ্লবে পুরো সমাজে আমূল পরিবর্তন আসে। মানুষের জীবনযাত্রা, চিন্তা-ভাবনা বদলে যায়, রাষ্ট্র ও সমাজের পুরো কাঠামো বদলে যায়।
অন্যদিকে, অভ্যুত্থান হলো সরকারের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ। অভ্যুত্থানে বিপ্লবের মতো আদর্শিক বা সাংগঠনিক কাঠামো থাকে না। প্রায়শই এগুলো প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে থাকে, খুব একটা পরিকল্পনা করে হয় না।[৪]
একটি উদাহরণ দিলে সহজে বুঝতে পারবে। সমাজ ও রাষ্ট্র যদি একটা বাড়ি হয়, তবে বাড়িটির মাটির উপরের অংশ ভেঙে আবার বানাই, তা হবে রাজনৈতিক বিপ্লব। আর যদি মাটির নিচের ভিতসহ ভেঙে নতুন করে বাড়ি বানাই, তা হবে সমাজ বিপ্লব। যদি বাড়িটির কোনো দরজা বা জানালা ভাঙি, সেটা হলো অভ্যুত্থান।
জুলাইকে যারা ‘বিপ্লব’ বলেন, তারা মূলত বোঝাতে চান এটি একটি রাজনৈতিক বিপ্লব। কারণ, যেহেতু এই আন্দোলনে কোনো নির্দিষ্ট আদর্শ ছিল না, সুসংগঠিত জনশক্তি ছিল না, বিপ্লবের পর সমাজে যে আমূল পরিবর্তন আসার কথা ছিল তা ঘটেনি, তাই এটি সমাজ বিপ্লব হতে পারে না। কিন্তু আমরা একটু আগেই দেখেছি যে, অভ্যুত্থান সাধারণত কোনো কিছুর প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নেয়। জুলাইয়ে বাংলাদেশের জনগণ হাসিনার জুলুম ও হত্যাযজ্ঞের প্রতিক্রিয়ার রাজপথে নেমেছে। এই আন্দোলন সুসংগঠিত ছিল না, সবাই নিজের মতো করে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। এখানে কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না। ইন্টারনেট শাটডাউন চলাকালীন সমন্বয়কদের নির্দেশনার অভাবে আন্দোলন থেমে থাকেনি। সেই সময় সারাদেশেই আন্দোলন হয়েছে।
তাছাড়া, আমরা জানি রাজনৈতিক বিপ্লবে রেজিমের পরিবর্তন হয়। সরকার, সরকারের নিকটবর্তী সুবিধাভোগী শ্রেণি, আমলাতন্ত্র, সামরিক বাহিনী ইত্যাদিতে মৌলিক পরিবর্তন আসে। কিন্তু জুলাইতে খুনি হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও সামরিক বাহিনী, সুবিধাভোগী, আমলাদের অবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
আগে যারা সরকারের কাছাকাছি থেকে সুবিধা ভোগ করেছে, তারাও বহাল তবিয়তে আছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে হাসিনার নিয়োগ করা সচিবরা (আমলা) এখনো নিজ পদে বহাল আছে। সরকারের নীতিতেও তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। হাসিনা গোপন চুক্তি করত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও আমেরিকার সাথে গোপন চুক্তি করছে।[৫] হাসিনার আমলে মিথ্যা জঙ্গি মামলা দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে ক্রসফায়ারে খুন করা হয়েছে, আয়নাঘরে গুম করে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। এই সরকারও নতুন করে জঙ্গি নাটক সাজানো শুরু করেছে।[৬] হাসিনার মতো ইউনূস সরকারও জনগণের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস স্থাপন করছে[৭], যা আমদের সমাজের নীতি-নৈতিকতার সাথে সাংঘর্ষিক অনেক বিষয় ও নানা ভূরাজনৈতিক সমস্যা বয়ে আনবে। এছাড়া খুনি হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচারের বিষয়ে জুলাই আন্দোলনের এক বছর পরেও ইতিবাচক কোনো অগ্রগতি নেই।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বিপ্লবের সাথে নয়, বরং অভ্যুত্থানের সাথেই জুলাইয়ের মিল পাই। হাসিনার জুলুমের অবসান ছিল এই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। রাষ্ট্র ও সমাজের অন্যান্য দিকে যৎসামান্য পরিবর্তন বাদে তেমন কিছুই বদলায়নি। তাই জুলাইকে ‘বিপ্লব’ বললে ভুল হবে। জুলাইকে ‘অভ্যুত্থান’ বলাই যথার্থ হবে।
ইতিহাস থেকে জালিম স্বৈরাচারি শাসকের নির্মম পরিণতির কিছু উদাহরণ দিয়ে এই আলোচনায় ইতি টানব।
১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির জেতার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে, তখন ফ্যাসিস্ট নেতা বেনিতো মুসোলিনিকে ক্ষমতাচ্যুত করে গ্রেফতার করা হয়। পরে জার্মান বাহিনী তাকে উদ্ধার করে এবং নাৎসি-নিয়ন্ত্রিত এক পুতুল রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে বসায়। কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার সময় সে বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ে। ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে তাকে হত্যা করা হয় এবং রাজধানী মিলানে তার লাশ উল্টো করে জনসম্মুখে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
১৯৮৯ সালের বিপ্লবের মাধ্যমে রোমানিয়ার শেষ কমিউনিস্ট স্বৈরশাসক নিকোলাই চাউশেসকুকে (Nicolae Ceaușescu) ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। স্ত্রীকে সাথে নিয়ে স্পেনে পালানোর সময় ধরা পড়ে সে। দ্রুতই গণহত্যা ও দুর্নীতির অভিযোগে তার বিচার করা হয় এবং অনতিবিলম্বে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে গুলি করে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
গত পনেরো বছর ধরে হাসিনা যে জুলুম করেছে, তাতে দুনিয়ার সবচেয়ে নির্মম, সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু তার প্রাপ্য। এটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। আজ হোক বা কাল, শহীদের রক্তের বদলা আমরা নেবোই, ইনশাআল্লাহ।
রেফারেন্স:
১. Huntington, S. P. (1968). Political order in changing societies. New Haven: Yale University Press.
২. Skocpol, T. (1979). States and Social Revolutions: A Comparative Analysis of France, Russia and China. United Kingdom: Cambridge University Press.
৩. Van Inwegen, P. (2011). Understanding revolution. Lynne Rienner Publishers.
৪. Tilly, C. (2004). Social Movements, 1768-2004. Routledge.
৫. bdnews24.com, (২০ জুলাই, ২০২৫), যুক্তরাষ্ট্রের ‘গোপন চিঠি’: মাথা নত নয়, যুক্তিসম্মত সমাধান চাই, https://tinyurl.com/22pt8e8k
৬. Shomoyer Alo, (১৭ জুলাই, ২০২৫), মিথ্যা জঙ্গি মামলায় ফাঁসিয়ে ইসলামপন্থিদের দমন করা হচ্ছে, https://tinyurl.com/3ctcvhk3
৭. BBC News বাংলা, (১৯ জুলাই, ২০২৫), ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের অফিস কী কাজ করবে, এ নিয়ে কেন কিছু দলের আপত্তি?, https://tinyurl.com/2vtzadvc