২০২৪-এর জুলাই, বাংলাদেশের ইতিহাসের এক নতুন মাইলফলক। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে দীর্ঘদিন ধরে চলা জুলুমের অধ্যায়। আওয়ামী জাহিলিয়াত ও খুনি হাসিনার রক্তপিপাসু হাত থেকে এদেশের মানুষ রক্ষা পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তবে সাধারণত এই ধরনের বড় কোনো ঘটনা ঘটলে মানুষ শুধু সেই ঘটনাটিকে আলাদা করে দেখে, অর্থাৎ ক্লাইম্যাক্সের দিকেই মানুষ বেশি মনোযোগ দেয়। কিন্তু এ ধরনের বড় ঘটনার পেছনে থাকে গভীর শেকড়। এ ধরনের আন্দোলন কোনো বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক ঘটনা নয়। বরং বহু মানুষের কুরবানি, তাদের উপর করা জুলুম, নির্যাতন, নানা সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাচক্রের সংমিশ্রণে মানুষের মনে ধীরে ধীরে জমা হয় ক্রোধ ও ক্ষোভ, যা কোনো একটা সময়ে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানও এর ব্যতিক্রম নয়। ষোলো বছরের অচিন্তনীয় নিপীড়ন মানুষের মনোজগতে এঁকে দিয়েছিল গভীর ক্ষত। ফলে চব্বিশের কোটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মানুষের তীব্র প্রতিবাদের আকাঙ্ক্ষার অনিবার্য বিস্ফোরণ। এই লেখায় আমরা এই বিস্ফোরণের শেকড় সন্ধান করার চেষ্টা করব এবং দেখব যে জুলাই কোনো একক ঘটনা না, বরং এই জমিনের মানুষের পুঞ্জিভূত দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, ক্ষোভ ও সংগ্রামের এক অনিবার্য পরিণতি।
২০০১: রৌমারী সীমান্তযুদ্ধ
২০০১ সালের ১৮ই এপ্রিল কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার বড়াইবাড়ি সীমান্তে ভারতের বিএসএফ অতর্কিত হামলা চালায় বিডিআর ক্যাম্পে। এই সংঘর্ষে ভারতের ১৬ জন এবং বাংলাদেশের ২ জন নিহত হয়।[১] এটা নিয়ে তখন প্রচুর আলোড়ন সৃষ্টি হয় দুই দেশে। তৎকালীন ভারতের ডিফেন্স মিনিস্টার উত্তপ্ত এক লোকসভায় সবার সামনে বলেন, এই ঘটনার বদলা নেওয়া হবে। বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা এবং বার বার সীমান্তে ভারতের পরাজয়ের রেশ ধরেই ২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মতো একটি ষড়যন্ত্র সাজায় ভারত।
২০০৯: পিলখানা হত্যাযজ্ঞ
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তর পিলখানায় ‘বিডিআর সপ্তাহ’ চলাকালীন সাজানো হয় এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র। এটি হয় আগ্রাসী ভারতের সরাসরি মদদে এবং হাসিনার নির্দেশে। সেদিন ৫৭ জন অফিসারকে নির্বিচারে হত্যা করে বিদ্রোহীরা, যাদেরকে ইন্ধন দিয়েছে ভারত ও তার পুতুল হাসিনা। সেনাবাহিনীকে অকার্যকর করে ফেলা এবং স্বৈরাচারের অনুগত বাহিনী তৈরি করাই ছিল এই গণহত্যার লক্ষ্য। খুব সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পিত এই হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের জন্য সেনাবাহিনীকে একটি অনুগত ও অকেজো বাহিনীতে পরিণত করা হয়, যারা আওয়ামী জাহিলিয়াতের বিরোধীদের দমন করত কঠোরভাবে, কিন্তু সীমান্ত হত্যা নিয়ে থাকত বরাবরই নিশ্চুপ। এই গণহত্যার মাধ্যমেই খুনি হাসিনা তার দেড় দশকের জুলুমের ভিত স্থাপন করে।[২][৩]
২০১৩: রক্তে রঞ্জিত শাপলা
২০১৩ সালের ৫ই মে, এ ভূখণ্ডের মুসলিমদের জন্য এক ভয়ানক কালো রাত। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের তথাকথিত রাজাকারবিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় নাস্তিক ব্লগার ও বামদের আন্দোলনে। যে নাস্তিকরা আমাদের প্রিয়নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আল্লাহ তাআলার নামে এত জঘন্য কটূক্তি করে যে, কোনো মুসলিম সেগুলো পড়ে সহ্য করতে পারবে না। এরই প্রেক্ষিতে হেফাজতে ইসলাম ৫ই মে ঢাকা অবরোধের ডাক দেয় এবং ১৩ দফা দাবি ঘোষণা করে।[৪] শাপলা চত্বরে অসংখ্য আলেম-উলামা এবং ধর্মপ্রাণ, নবীপ্রেমী মুসলিম জড়ো হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এই সমাবেশে রাতের গভীরে মতিঝিলের মতো একটা জায়গায় ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ করে খুনি হাসিনার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্মম গণহত্যা চালায়। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী, সেই রাতে আন্দোলনকারীদের উপর প্রায় ১ লক্ষ ৫৫ হাজার রাউন্ড বুলেট এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়।[৫] শত শত ধর্মপ্রাণ মুসলিমকে শহীদ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিক পরেরদিনই খুনি হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে বলে, আন্দোলনকারীরা নাকি রং মেখে শুয়ে ছিল, কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এ ধরনের নির্মম ও নিষ্ঠুর গণহত্যার নজির ইতিহাসের পাতায় খুব কম পাওয়া যায়।
২০১৮: কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন
২০১৮ সালে পরপর বড় দুটি আন্দোলন সংগঠিত হয়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের শুরু করা আন্দোলন সারাদেশে ব্যাপক সমর্থন পায়। সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমদিকে আশ্বাসের বাণী শোনানো হলেও পরবর্তীতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ ও আওয়ামীলীগের গুন্ডা বাহিনী ছাত্রলীগ হামলা চালায়। ছাত্রদের উপর ব্যাপক দমন-পীড়ন, হামলা এবং মিথ্যা মামলার ঘটনার ফলে তরুণদের মনে তৈরি হয় সরকারের প্রতি তীব্র আক্রোশ।[৬]
এই আন্দোলনের রেশ কাটতে না কাটতেই জুলাই-আগস্টে শুরু হয় নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। বাস চাপায় দুই স্কুল শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে সারাদেশের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। কিন্তু ঠিক আগের মতোই সরকার তার হেলমেট বাহিনী ওরফে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগকে দিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়। আন্দোলন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে।[৭] পরপর এই দুটি আন্দোলনে দমন-পীড়নের এই ঘটনার ফলে তরুণ প্রজন্মের মনে ক্ষোভ জমতে থাকে, যা পরবর্তীতে ২০২৪-এর জুলাইতে এসে আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হয়।
২০২১: মোদীবিরোধী আন্দোলন
২০২১ সালের ২৬ মার্চ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী, গুজরাটের কসাই নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা বিক্ষোভের ডাক দেয়। হেফাজতে ইসলামসহ সাধারণ ইসলামপ্রিয় জনতা মোদীর আগমনের কঠোর বিরোধিতা করে। যার হাতে শত শত মুসলিমদের রক্ত লেগে আছে, তাকে সরকারিভাবে দেশে এনে আপ্যায়ন করা হবে—এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না কেউ। আবার, ঠিক আগের মতোই ধর্মপ্রাণ নিরীহ মুসলিমদের উপর জালিম নির্বিচারে গুলি চালায়, শহীদ হয় বহু মানুষ। আন্দোলনকারীরা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে বায়তুল মোকাররমে প্রবেশ করে, কিন্তু বাইরে থেকে সরাসরি মসজিদের ভেতরেও গুলি চালানো হয়। বায়তুল মোকাররমের সিঁড়ি দিয়ে আমাদের ভাইদের তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য আজও মনে পড়ে। অন্যান্য বারের মতো সেবারও আওয়ামী জাহিলি সরকার সকল দায় এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়।[৮]
২০২৪: জুলাই গণঅভ্যুত্থান - কফিনের শেষ পেরেক
পূর্বের সবগুলো ঘটনা ২০২৪-এর জুলাইয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। মানুষের মনে জমে থাকা দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, ক্রোধ ও আক্রোশ একসাথে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তরুণরা জীবনের তোয়াক্কা না করে রাজপথে নেমে আসে। সবার মনে একটাই চিন্তা, খুনি লীগ ও হাসিনাকে চিরতরে বিদায় করতেই হবে, যেকোনো মূল্যে।
শুরুটা ছিল ২০১৮ সালের মতো কোটা সংস্কারের আন্দোলন দিয়েই। কিন্তু জুলাইয়ের ১৫ তারিখে ছাত্রলীগ যখন আন্দোলনকারীদের উপর নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হামলা চালায়, তখন তা ব্যাপকভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং জনমনে আক্রোশ তুঙ্গে পৌঁছায়।[৯][১০] এরপরে ১৬ তারিখে আবু সাঈদের উন্মুক্ত বুকে গুলি চালানোর ভিডিও দেখে ছাত্র-জনতা আর ঘরে বসে থাকতে পারেনি।[১১] বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা ক্রোধ আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠে। ছাত্রদের উপর দমন-পীড়ন, গুলি চালানো, ইন্টারনেট বন্ধ করে ধরপাকড়, রাতের অন্ধকারে বাসায় বাসায় গিয়ে গ্রেফতার করা—কোনোকিছুই আন্দোলনকে স্তিমিত করতে পারেনি। খুনি হাসিনার প্রতি দিন দিন জনরোষ বাড়তেই থাকে এবং ক্রমান্বয়ে তা ১ দফা আন্দোলন অর্থাৎ সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।[১২] অবশেষে ৫ই আগস্ট, লং মার্চে রাজধানীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় করে। চূড়ান্ত গণআন্দোলনের মুখে খুনি হাসিনা ও তার দলবল দেশত্যাগ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।[১৩][১৪][১৫]
দীর্ঘকালের এই জুলুম এবং জুলাই অভ্যুত্থান এটাই প্রমাণ করে যে, চিরকাল কোনো জালিম টিকে থাকতে পারে না। রৌমারি থেকে পিলখানা, শাপলা চত্বর, কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, মোদীবিরোধী আন্দোল—প্রত্যেকটা ঘটনা বিচ্ছিন্ন মনে হলেও, তা ছিল এ ভূখণ্ডের মানুষের আযাদির ধারাবাহিক সংগ্রামের অংশ। এই ঘটনাগুলো একত্রিত হয়েই তৈরি হয় এক অনন্য প্রতিরোধের ইতিহাস। যে ইতিহাস বারবার প্রমাণ করে দেয়, জুলুম যতই দীর্ঘ ও অসহনীয় হোক, প্রতিরোধ একদিন আসবেই এবং সেই প্রতিরোধই জাতির ভবিষ্যতের রূপরেখা অংকন করে দেয়। জুলাইয়ের এই প্রতিরোধও কেবল একদিনের ফসল নয়, বরং এটি ছিল বহু বছরের পুঞ্জিভূত আক্রোশের অনিবার্য প্রতিক্রিয়া।
রেফারেন্স:
১. BBC News বাংলা, (১৬ এপ্রিল, ২০২৫), বড়াইবাড়ী যুদ্ধ: কুড়িগ্রামে কুড়ি বছর আগের যে সংঘাতে ১৬ জন ভারতীয় রক্ষী নিহত হয়, https://tinyurl.com/5ccntrwz
২. Banglanews24, (২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২), বিডিআর বিদ্রোহ: সেদিন যা ঘটেছিল, https://tinyurl.com/399txc9t
৩. দৈনিক আমার দেশ, (২৫ জুন, ২০২৫), পিলখানা হত্যাকাণ্ড দীর্ঘমেয়াদি ষড়যন্ত্রের ফল, ছিল সশস্ত্রবাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা, https://tinyurl.com/bdzhsyjz
৪. bdnews24.com, (৭ এপ্রিল, ২০১৩), হেফাজতের ১৩ দাবি, https://tinyurl.com/4m8f7b7w
৫. দৈনিক সংগ্রাম, (৫ মে, ২০২৫),শাপলা চত্বরে হাসিনার নির্দেশে চলে র্যাব পুলিশ বিজিবির তান্ডব. https://tinyurl.com/3dukwz4z
৬. ২০১৮-এ বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন, In Wikipedia. https://shorturl.at/aVFa1
৭. জান্নাতুল তানভী, (১৬ মে, ২০২৫), কেমন ছিল ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন? BBC News বাংলা, https://tinyurl.com/fardrped
৮. ২০২১-এ বাংলাদেশে মোদী-বিরোধী বিক্ষোভ, In Wikipedia. https://shorturl.at/4LrXC
৯. Bangladesh students clash in job quota protests, at least 100 injured. (2024, July 14). Reuters. https://tinyurl.com/y2n6ta8k
১০. BCL, quota protesters clash. (2024, July 15). The Daily Star. https://tinyurl.com/2vsmrwc2
১১. পুলিশের ছররা গুলিতেই আবু সাঈদের মৃত্যু, (2024, September 25), প্রথম আলো, https://tinyurl.com/2pwej73r
১২. শহীদ মিনার থেকে এক দফা ঘোষণা, (2024, August 3), মানবজমিন, https://tinyurl.com/2mb2xdjx
১৩. বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি সোমবার, (2024, August 4), প্রথম আলো, https://tinyurl.com/4rr8eupf
১৪. Yee, I., & Ripon, T. M. (2024, August 6). Bangladesh Prime Minister flees to India as anti-government protesters storm her residence. CNN. https://tinyurl.com/c4stjwzx
১৫. ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, In Wikipedia. https://shorturl.at/OUOv9