মুহাম্মদ বুয়াজিজি। তিউনিসিয়ার ছোট্ট এক শহরে সবজি ফেরি করে বেড়ায়। দারিদ্র্য ক্লিষ্ট জীবন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী সে। সবজি ফেরি করতেও নানা অন্যায়-অবিচারের শিকার হতে হয় তাকে। একদিন এক পুলিশ ইন্সপেক্টার তার কাছ থেকে জরিমানা চাইলো। রাস্তায় সবজি বিক্রি করার জন্য কীসের জরিমানা? টাকা দিল না বুয়াজিজি। বিনিময়ে পুলিশ তার উপার্জনের একমাত্র সম্বল ভ্যানটা ভেঙে দিল। নালিশ নিয়ে পুলিশে গেল, পৌরসভায় গেল, এমনকি গভর্নরের দোরগোড়ায় গিয়েও দাঁড়াল বুয়াজিজি—প্রতিবারই ফিরল মার খেয়ে, চোখে জল নিয়ে। এই অন্যায়, অপমান, বৈষম্য সহ্য করতে না পেরে সরকারি কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিল। আগুনের শিখা যেন তার শরীরকে নয়, পুরো দেশের ঘুমন্ত আত্মাকে পুড়িয়ে জাগিয়ে তুলল। বুয়াজিজির আত্মহুতির ছবি-ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল পুরো দেশে। তার জ্বালানো একটি স্ফুলিঙ্গ পুরো আরব বিশ্বে বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে দিল। আরব বসন্তে পতন হলো তিউনিশিয়া, মিশর, ইয়েমেন ও লিবিয়ার জালিম শাসকদের। 

মাসজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে। জালিম সরকারের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। এক পর্যায়ে ১৪ জুলাই তো হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতি’ বলে ফেলল। ঢাবি শিক্ষার্থীরা মাঝরাতে ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান দিয়ে মিছিল বের করল। পরদিন ঢাবি ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর জালিমের পোষা গুণ্ডাবাহিনী ছাত্রলীগ হামলে পড়ল। নারী শিক্ষার্থীদেরকেও অমানবিক নির্যাতন করল। সেই হামলার ছবি-ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল ঝড়ের বেগে। বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ল পুরো দেশে। ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ খুনি পুলিশের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল। বুকের ভেতরে জমে থাকা ঝড় সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে শহীদ হলো। সেই ঝড়ই গুড়িয়ে দিল খুনি হাসিনার জুলুমের সাম্রাজ্য। 

উপরের দুটো ঘটনার একটি গত দশকের, অন্যটি গত বছরের। একটি আরব বিশ্বের, অন্যটি বাংলাদেশের। মাঝখানে অনেকগুলো বছর ও অনেক দূরত্বের ফারাক থাকলেও দুটো ঘটনার মধ্যে অনেকগুলো মিল। সেগুলোর মধ্যে একটি আজ আমাদের আলোচনার বিষয়: সোশ্যাল মিডিয়া।

তিউনিশিয়ার অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি যে সোশ্যাল মিডিয়া অবদান রেখেছে তা হলো ফেইসবুক। এটি ছাড়া নিঃসন্দেহে আন্দোলনের গতি কম হতো এবং এটি সহজেই দমন করা যেত।[১] এক আন্দোলনকারী বলেন, “এক হাতে পাটকেল, অন্য হাতে ফোন নিয়ে আন্দোলনকারীরা রাজপথে নেমে এসেছিল”।[২] আন্দোলনকারীরা তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশের নৃশংস হামলার ভিডিও করে ফেইসবুক, টুইটার (বর্তমানে এক্স) ও ইউটিউবে পোস্ট করে দিত এবং আল-জাজিরার মতো স্যাটেলাইট সংবাদ মাধ্যমগুলো তা প্রচার করত। মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোর বেশিরভাগই সরকার নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত ছিল। তাই সত্য খবরের জন্য সেগুলোর উপর নির্ভর করা যেত না। রিয়েল টাইম খবরের জন্য মানুষজন সোশ্যাল মিডিয়ার উপর নির্ভর করত। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আন্দোলনকারীরা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করত। কখন, কোথায় আন্দোলন হবে তা প্রচার করা হতো। এভাবেই সোশ্যাল মিডিয়া তিউনিশিয়ার অভ্যুত্থানকে প্রভাবিত করেছিল।

এবার জুলাই অভ্যুত্থানে সোশ্যাল মিডিয়ার অবদান নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

সমন্বয় ও সংগঠন: আন্দোলনকারীরা, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য ফেইসবুক ও টেলিগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন গ্রুপ ব্যবহার করত।[৩] এখানে তারা আন্দোলনের পরিকল্পনা এবং স্থান-সময় নির্ধারণ করত। দেশের প্রায় সবগুলো জেলার আন্দোলনের আপডেট দেওয়ার জন্য ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে এক বা একাধিক ফেইসবুক গ্রুপ ছিল। কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ ব্যবহার হয়েছিল। 

২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে যে সকল স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছিল, তারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এবং তারাই জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিল। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের জন্য বিভিন্ন গ্রুপ ব্যবহার করেছিল। এই গ্রুপগুলোই জুলাই আন্দোলনেও আন্দোলনকারীদের সমন্বয় করার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে।[৪] 

তথ্য ও সংবাদ প্রচার: হাসিনার পনেরো বছরের শাসনামলে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোর বেশিরভাগই ছিল সরকার নিয়ন্ত্রিত[৫]। তারা আওয়ামী লীগের বয়ানই প্রচার করত এবং তাদের অপকর্মের বৈধতা উৎপাদন করত। তাই সত্য ও নিরপেক্ষ সংবাদের জন্য এগুলোর উপর নির্ভর করা যেত না। আন্দোলন ও দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের জন্য মানুষজন সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেইসবুকের উপর নির্ভরশীল ছিল। 

অনেক আন্দোলনকারী ফেইসবুক লাইভ ও পোস্টের মাধ্যমে আন্দোলনের রিয়েল টাইম আপডেট জানাত। কোথায় পুলিশ বা ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুণ্ডারা ওঁত পেতে আছে, সেই খবরও আন্দোলনকারীরা ফেইসবুকের মাধ্যমে পেত। সেসব এলাকা এড়িয়ে চলত বা একা যেত না। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা বাদে বৃহত্তর জনতার কাছে আন্দোলনের খবর পৌঁছানোর জন্য ফেইসবুক পোস্ট ও রিলস ছিল সর্বোত্তম মাধ্যম। 

আন্দোলনে যেতে উৎসাহিত করা: পুলিশ ও লীগের বর্বরতার ভিডিওগুলো যখন ছড়িয়ে পড়তে লাগল, তখন জনগণের ক্ষোভ দ্রুত বেড়ে গেল। এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ রাজপথে নামতে শুরু করল। এসব ভিডিও মানুষের মনে তীব্র আবেগের জন্ম দেয়, ফলে শুধু ছাত্ররা নয়—সব বয়স ও শ্রেণির মানুষ আন্দোলনে যোগ দেয়। ইস্যুটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ায় বাবা-মা এবং সন্তানরা একসাথে প্রতিবাদে অংশ নেয়।[৬]

এছাড়া মানুষকে আন্দোলনে নামতে উৎসাহিত করতে সোশ্যাল মিডিয়ার অনেক পরিচিত মুখ অবদান রেখেছে। মানুষকে লং মার্চে যোগ দেওয়ার আহ্বান করে ৪ অগাস্ট লেখক, চিন্তক ও গবেষক আসিফ আদনান ভাইয়ের করা এক ফেইসবুক পোস্ট বেশ সাড়া ফেলে দেয়। এখন পর্যন্ত সেই পোস্টে রিয়েক্ট ২৮ হাজার ও শেয়ার ১৯ হাজার। অসংখ্য মানুষ সেই পোস্টটি সরাসরি কপি-পেস্ট করে নিজের প্রোফাইল থেকে পোস্ট করে। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অন্যতম বড় সংগঠন PUSAB তাদের ফেইসবুক পেইজ থেকে সেই পোস্টটি শেয়ার করে। তোমাদের কি সেই ইমাম সাহেবের পোস্টটার কথা মনে আছে, যিনি বলেছিলেন, “লীগের জানাযা কেউ না পড়ালে আমি পড়াব। আপনারা যত পারেন মুর্দা হাজির করেন”? সেই পোস্টটা সেসময় অনেক প্রভাব ফেলেছিল। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎস আন্দোলনে অংশ নিয়ে ও পোস্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। এছাড়াও পিনাকি ভট্টাচার্য, ইলিয়াস হোসেইনের মতো ইউটিউব কন্টেন্ট ক্রিয়েটররাও আন্দোলনকে গতিশীল করতে অবদান রেখেছে।

মিমিং: আন্দোলন চলাকালীন বিভিন্ন বিষয় মজার ছলে ট্রল করে উপস্থাপন ও সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে নিজেদের অসম্মতি জানান দিতে আন্দোলনকারীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় মিমিং করেছে। হাসিনার মায়াকান্না নিয়ে ‘স্বজন হারানোর বেদনা’, ইন্টেরনেট শাটডাউন নিয়ে ‘ইন্টারনেট বন্ধ করিনি, নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে গেছে’, ছয় সমন্বককে আটকে রেখে জোর করে আন্দোলন সমাপ্তির ঘোষণা পাঠ করা নিয়ে ‘হাউন আঙ্কেলের ভাতের হোটেল’ ইত্যাদি নানা মিম সেই সময় আন্দোলনকে গতিশীল রাখতে অবদান রেখেছে।

সরকারের প্রতিক্রিয়া: আন্দোলন দমন করতে সরকার ১৫ জুলাই থেকে ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়া ব্লক করে দেয় এবং ১৮ জুলাই ইন্টারনেট শাটডাউন করে দেয়। এই সময়ে পুলিশ ও র‍্যাব ব্যাপক ধরপাকড় চালায়, সারাদেশে সরাসরি গুলি করে আন্দোলনকারী ও নিরীহ মানুষদের হত্যা করে। এই সময় যোগাযোগ করার জন্য ফোনকল ও এসএমএস ব্যবহার করত মানুষজন।

আমরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য WarpChat ব্যবহার করতাম। কারণ ফোনকল ও এসএমএস-এর উপর সরকারি নজরদারি ছিল। সেসময় দেশের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ যোগাযোগের জন্য এই অ্যাপটি ব্যবহার করেছে।[৮] এপটি চালাতে কোনো ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন হয় না। এছাড়া দেশজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলো একটি স্ট্যাটিক সার্ভার থেকে জানতে পারতাম। সমন্বয়কদের নির্দেশনা ছাড়াই এ সময় পুরো দেশে আন্দোলন চলেছে।

২৪ তারিখ থেকে আবার ইন্টারনেট সংযোগ চালু করা হলে মধ্যবর্তী সময় পুলিশের নির্বিচার খুনের ভিডিওগুলো সামনে আসতে থাকে। এগুলো দেখে মানুষের ক্ষোভ এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে যায়। এবার আন্দোলন আর দমন করার পর্যায়ে থাকে না। সারাদেশে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে নামতে থাকে। এ পর্যায়ে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেও জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়াগুলো ব্যান করে রাখা হয়। মানুষজন VPN ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার চালিয়ে যায়।

শেষ কথা: সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা রিল দেখে, স্ক্রল করে অনেক সময় নষ্ট করি। কিন্তু এই সোশ্যাল মিডিয়াকেই আমরা প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করতে পারি। এর স্পষ্ট উদাহরণ জুলাই অভ্যুত্থান। সোশ্যাল মিডিয়া সামাজিক আন্দোলনকে নতুন সুযোগ ও সরঞ্জাম দেয়। জনগণ স্বাধীনভাবে সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিজেদের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি জানতে ও জানাতে পারে। ছোট বার্তা বা দীর্ঘ ভিডিওর মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে পারে, অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে দিতে পারে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয় করতে পারে। তিউনিশিয়ার আন্দোলনের সাফল্য সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়েছিল পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয়। বাংলাদেশেও জুলাই অভ্যুত্থানে আন্দোলন সমন্বয় করতে ও গতিশীল রাখতে সোশ্যাল মিডিয়া অনন্য অবদান রেখেছে। তাই সোশ্যাল মিডিয়া কেবল বিনোদনের জন্য নয়, বরং যেকোনো অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ জানাতে, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে ব্যবহার করব। সোশ্যাল মিডিয়াকে করে তুলব জুলুমের ভিতে আঘাত করার হাতিয়ার।


রেফারেন্স:

১. Hassan, S. (2015). Social media and the Arab Spring. Master’s Thesis, Graduate School Camden, Rutgers, the State University of New Jersey. https://doi.org/doi:10.7282/T3XD13C5

২. Ryan, Y. (2011, January 26). How Tunisia’s revolution began. Al Jazeera. https://tinyurl.com/26n6awd7

৩. Turzo, Md. A. P. (2024). The impact of digital platforms on Bangladesh’s 2024 Student-Led Revolution: Analysing the role of Social Media as a catalyst. https://tinyurl.com/ees244aa

৪. অনুপম দেবাশীষ রায় (২০২৫), বিদ্রোহ থেকে বিপ্লব: নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে জুলাই অভ্যুত্থান, ঐতিহ্য।

৫.  Islam, S.-E.-R. (2024). Social media as a catalyst for mobilizing mass protests during the July movement in Bangladesh. Bangladesh Institute of Peace and Security Studies (BIPSS). https://tinyurl.com/54dn3k89

৬. Anjum, S. (2024, August 12). From social media to the streets: How Bangladesh’s Gen-Z movement overcame internet shutdowns to overthrow an autocrat. Tech Policy Press. https://tinyurl.com/586ejzup

৭. Ashfaqe, S. A. (2025, July 17). WarpChat: The app that sustained online resistance during internet blackout. The Daily Times of Bangladesh. https://tinyurl.com/43hej8fk