ঈদ শেষ হয়ে গিয়েছে। আম্মুর হাতের বিরিয়ানি ফুরিয়ে গিয়েছে, নতুন কাপড়গুলো বেশ কয়েকবার পরা হয়েছে, কিছুটা ময়লাও হয়ে গিয়েছে। আর সালামির টাকাগুলো হয় আম্মুর চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপন কোথাও জমা আছে, নয়তো নিমিষেই খরচ হয়ে গিয়েছে। তবে এগুলো বড় সমস্যা না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ঈদের ছুটি শেষ, স্কুল খুলে গিয়েছে। কিন্তু ব্রেইন কিছুতেই তা মেনে নিতে রাজি না!

ঈদের ছুটির পর নতুন করে পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়ার মতো কঠিন কাজ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। ‘আজই শেষ ছুটি, কাল থেকে পড়তে বসব’, ‘আরে ঈদ তো ৭ দিন’—পড়ার কথা চিন্তা করলে এমন কত যে অজুহাত মাথায় আসে ইয়ত্তা নেই। শেষমেশ আড়মোড়া ভেঙে পড়তে বসলেও বাঁধে বহু ঝামেলা। এক মুহূর্ত বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি, পরের মুহূর্তে মাথায় ঘুরে বিরিয়ানি কিংবা কাবাব, এবার ঈদে কোন কোন মজার কাজ করা হয়নি, বা অমুক কাজিনের কথা যে সালামির টাকা ধার নিয়ে গায়েব হয়ে গিয়েছে। যদি তোমার অবস্থাও এমন হয়, তাহলে চিন্তা কোরো না—তুমি একা নও।

আজ তোমাকে শেখাব ঈদের পর পড়াশোনায় মনোযোগ ফেরত আনার নিনজা টেকনিক। চলো শুরু করি।

১. প্রথমেই স্বীকার করে নাও যে “ঈদ শেষ”

হ্যাঁ, একটু কষ্ট হবে। কিন্তু এই কাজটা করা জরুরি। তোমার সমস্যার মূল কারণ হলো তুমি এখনো ঈদের আমেজে আটকে আছো, ঈদ মোডে আছো। ঘুম থেকে উঠে মনে হচ্ছে আবার সেমাই খাবে। কিন্তু সামনে সেমাই নেই, পড়ে আছে হোমওয়ার্ক! বিষয়টা কষ্টের। কিন্তু বাস্তবতা মেনে না নিলে সামনে এগোনো যাবে না।

এখনো ঈদ মোডে আছো কিনা যাচাই করার জন্য দেখো তোমার সাথে এগুলো ঘটছে কি না-

  • ভুল করে এখনো স্যারকে ‘ঈদ মুবারক, স্যার!’ বলে ফেলছো।
  • এখনো বাসায় কোনো মেহমান আসলে আশা করছো সে সালামি দিয়ে যাবে।
  • বই খোলার পরেও মাথার মধ্যে “ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে…” বাজতে থাকে।

এরকম হলে ছোটখাটো একটা চিৎকার দিয়ে নিজেকে বলো, ‘ঈদ শেষ বস! এখন পড়াশোনা শুরু করতে হবে!’

২. কঠিন বিষয় নয়, সহজ বিষয় দিয়ে পড়া শুরু করো 

একটা লম্বা ছুটির পর হঠাৎ করেই হায়ার ম্যাথের ত্রিকোণমিতি, হিসাববিজ্ঞানের জাবেদা কিংবা ইতিহাসের লম্বা বর্ণনা পড়তে গেলে তোমার ব্রেইন বিদ্রোহ করে বসবে। আর পড়তে ইচ্ছে করবে না। তাই আগে সহজ কিছু দিয়ে শুরু করো:

  • আগের নোটগুলোয় একবার চোখ বুলিয়ে নাও, পড়ো বা অন্তত পড়ার ভান করো!
  • পড়ার টেবিল গুছিয়ে নাও। টেবিল অগোছালো থাকলে পড়ায় মনোযোগ দেওয়া কঠিন। পড়ার টেবিল পরিষ্কার থাকলে মন ফুরফুরে লাগবে।
  • একটা স্টাডি প্ল্যান বা রুটিন বানাও। মানবে কি মানবে না সেটা পরের কথা, কিন্তু একটা প্ল্যান থাকা ভালো!

এগুলো ওয়ার্ম-আপ। মূল খেলায় নামার আগে যেমন শরীরকে প্রস্তুত করে নিতে হয়, তেমনি কঠিন পড়ায় ঝাঁপ দেওয়ার আগে তোমার মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করে নেওয়ার জন্য এই কাজগুলো করো।

৩. ‘অজুহাত দেওয়া বন্ধ’ - এই নিয়ম চালু করো

যে মুহূর্তে পড়ার কথা চিন্তা করবে, তোমার মাথায় পড়াশোনা এড়ানোর অজুহাতের মেলা বসবে:

  • ‘আরেক ম্যাচ গেমস খেলে তারপর পড়ব…’
  • ৫ মিনিট ঘুমাই, তারপর পড়ব!’ (এই ৫ মিনিট ২০২৬ সালেও শেষ হবে না)
  • ঠিক ৪:০০ টা বাজে পড়া শুরু করব!’ (এরপর হবে ৫টা, তারপর ৬টা, তারপর… এমন করতে করতে আর কোনোদিন পড়তে বসা হবে না!)

পড়া থেকে বাঁচতে তোমার ব্রেইন এসব অজুহাত বানিয়ে তোমাকে দিচ্ছে!

এগুলো থেকে মুক্তির নিনজা টেকনিক:

  • ৫ মিনিট নিয়ম: নিজেকে বলো, ‘শুধু ৫ মিনিট পড়ব।’ একবার পড়া শুরু করলে, পড়ায় মনোযোগ চলে এলে চালিয়ে যাওয়া সহজ হয়ে যায়।
  • ফোন দূরে রাখো। হ্যাঁ, এটা করতে কষ্ট হবে। কিন্তু রিল স্ক্রল করলে তুমি পড়ায় মনোযোগ দিতে পারবে না।
  • নিজেকে কোনো বিকল্প দেওয়া থেকে বিরত থাকো। নিজেকে বলো, ‘হয় পড়তে বসব, নাহয় কিছুই করব না।’ কোনো কিছু না করে বসে থাকা খুব বিরক্তিকর। এই বিরক্তি থেকে বাঁচতে তোমার ব্রেইন পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী হবে।

৪. ঈদের জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলো

তুমি যদি ঈদের আমেজ থেকে বের হতে না পারো, তবে পড়াশোনায় মন বসবে না। তাই কিছু ডিটক্স করো:

  • পড়ার টেবিল থেকে ঈদ কার্ড, চকলেট, স্ন্যাক্স সরিয়ে ফেলো।
  • কাজিনদের হোয়াটসঅ্যাপ/ফেসবুক গ্রুপ মিউট করো। কেননা ওরা এখনো ঈদের ঘোরাঘুরির ছবি গ্রুপে শেয়ার করছে!
  • সালামির টাকা লুকিয়ে রাখো। বারবার টাকা গুনলেও তা বাড়া বা কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। আছে নাকি!
  • ঈদের সাথে সম্পর্কিত সকল জিনিসপত্র সরিয়ে ফেললে দেখবে পড়াশোনায় এখন একটু হলেও মন দিতে পারছ।

৫. নিজেকে পুরস্কার দাও (যেভাবে আত্মীয়রা তোমাকে সালামি দিয়ে খুশি করেছে)

  • ই চ্যাপ্টার শেষ করলে ১৫ মিনিট ইউটিউব দেখব।’·
  • হোমওয়ার্ক শেষ করতে পারলে পছন্দের খাবার খাব।’
  • ২ ঘণ্টা পড়লে ৩০ মিনিট রেস্ট নেব।’

এভাবে তোমার ব্রেইনকে পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে পড়াশোনায় আগ্রহী করা সম্ভব!

৬. ঘুম ঠিক করো 

ঈদের কয়েকদিন একটু অনিয়ম হয়, রাত জাগা, দেরি করে খাওয়া, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেওয়া। হঠাৎ একদিন সকাল সাতটায় পড়তে বসলে তোমার ব্রেইন রীতিমত অনশনের ডাক দেবে!

তাই ঘুম ঠিক করতে:

  • সময়মতো ঘুমাতে যাও। এটা মানা কঠিন, কিন্তু অতীব জরুরি! রাতে ঠিকঠাক ঘুম হলে পড়ার সময় আর ঝিমুনি আসবে না!
  • বাদ ফজর ঘুম ধরলেই মুখে ঠান্ডা পানি দাও। (ঠান্ডা পানি = মুহূর্তেই ঘুম উধাও)

৭. বন্ধুদের সাহায্য নাও

একজন ভালো স্টাডি পার্টনার খুঁজে নাও, যে তোমাকে মোটিভেট করবে। তবে এক্ষেত্রে সচেতনতার সাথে বন্ধু বাছাই করতে হবে। ছেলেরা মেয়েদের এবং মেয়েরা ছেলেদের বন্ধু বানাবে না।

  • একজন ভালো স্টাডি পার্টনার তোমাকে পড়তে সাহায্য করবে, দায়িত্বশীল হবে।      
  •  খারাপ স্টাডি পার্টনার  বলবে, ‘চল, এক ম্যাচ গেম খেলি। তারপর পড়তে বসব!’  দেখা যাবে সেই গেমস তিন ঘণ্টায়ও শেষ হচ্ছে না।

শেষমেশ একটা কথাই বলব, বেশি চিন্তা কোরো না। একটু কষ্ট করে পড়া শুরু করে দাও! প্রতিটা কাজের সবচেয়ে কঠিন অংশ হলো শুরু করা। পড়াশোনাও এর ব্যতিক্রম না। পড়াশোনা শুরু করা কঠিন। কিন্তু একবার মনোযোগ চলে এলে কাজ সহজ হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ। আশা করি এবার ঈদের পর পড়াশোনা শুরু করতে আর প্যারা লাগবে না। উপরের টেকনিকগুলো ফলো করে একেবারে পড়াশোনার নিনজা হয়ে উঠবে। কী, পারবে না?

[ষোলো ঈদ সংখ্যা ২০২৫ এ প্রকাশিত]