ঈদ মুসলিমদের আনন্দ উৎসব। এ ভূখণ্ডের অধিবাসীদের হাজার বছরের সংস্কৃতি। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় জাঁকজমক ও ধর্মীয় নিষ্ঠার সাথে উদযাপিত হয়ে আসছে ঈদ। তোমাদের কি কখনো জানতে ইচ্ছে করেছে, প্রাচীন বাংলায় ঈদ কেমন ছিল? আমাদের পূর্বপুরুষেরা কীভাবে ঈদ উদযাপন করতেন? চলো, টাইম মেশিনে করে পাড়ি জমাই প্রাচীন বাংলায় এবং দেখে আসি আমাদের বর্ণাঢ্য ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।  

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

প্রাচীন বাংলা তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত ছিল। দিল্লি ও বাংলা সালতানাত এবং মুঘল সাম্রাজ্যের হাত ধরে ইসলামী ঐতিহ্যের আগমন ঘটে বাংলায়। গড়ে ওঠে এক অনন্য সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য[১]। ঈদ কেবল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছিল না; বরং এটি ছিল চিরায়ত বাংলার সামাজিক উৎসব। ঈদ ছিল আনন্দ, ঐক্য এবং সামাজিক সম্প্রীতির প্রতীক।

ঈদের প্রস্তুতি

চাঁদ দেখার মাধ্যমে ঈদের আমেজ শুরু হতো। প্রাচীন বাংলায় মানুষ মসজিদের আঙিনায় বা খোলা মাঠে একত্রিত হতো নতুন চাঁদ দেখার জন্য। স্থানীয় কাজী (ধর্মীয় নেতা) ঈদের চাঁদ দেখার ঘোষণা দিতেন। এই খবর ঢাক পিটিয়ে গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হতো। ঈদের আনন্দে সারা গ্রামের পরিবেশ মুখোর হয়ে উঠত।

হাট-বাজার জমজমাট হয়ে উঠত। মানুষজন নতুন পোশাক, মিষ্টি ও উপহার কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। তখনকার ঈদে পুরুষেরা সাধারণত লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরত, আর মহিলারা পরতেন হাতে বোনা শাড়ি। ঈদে নতুন কাপড়ের চাহিদা মেটাতে তাঁতি ও কারিগরদের কাজের চাপ বেড়ে যেত। ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে সাজানো হতো। পরিবারের নারীরা রাত থেকেই ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু খাবার তৈরির আয়োজন শুরু করে দিতেন। 

ঈদের দিনের আনুষ্ঠানিকতা

ঈদের সকালে মানুষ ঈদগাহে সমবেত হয়ে ঈদের সালাত আদায় করত। ঈদের সালাতের জমায়েত হতো বিশাল। বিভিন্ন গ্রামের মানুষ একত্রিত হতো সেখানে। তখন ঈদগাহ এখনকার মতো বাঁধানো ছিল না। বড় খোলা মাঠে ঈদের সালাতের আয়োজন করা হতো।

প্রাচীন বাংলায় ঈদের অন্যতম প্রধান দিক ছিল দান-খয়রাত। ফিতরা (সাদাকাহ) দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক, যাতে দরিদ্ররাও ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারে। শাসক ও ধনী পরিবারগুলো গরিবদের মাঝে খাবার, পোশাক ও অর্থ বিতরণ করত। এতে করে সমাজে সহমর্মিতা ও সামাজিক সাম্য গড়ে উঠেছিল। ঐতিহাসিক নথি থেকে জানা যায়, বাংলার শাসকরা ঈদে গরিব-দুঃখীদের জন্য বড় ভোজের আয়োজন করতেন।[২] 

ঈদের সালাত শেষে সবাই কোলাকুলি করত, একে অপরকে শুভেচ্ছা জানাত। এরপর আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখা-সাক্ষাৎ করত। এর মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হতো।

ঈদের খাবার-দাবার

আমরা বাঙালিরা বরাবরই ভোজন রসিক। তাই সে সময় ঈদের মূল আকর্ষণ ছিল সুস্বাদু খাবার। প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের দাওয়াত করে একসাথে খাওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। ঈদের জনপ্রিয় খাবারগুলোর মধ্যে ছিল—সুগন্ধি চালের পোলাও ও কোরমা, সেমাই, সুগন্ধি চালের পায়েশ, গুড়, দুধ, নারকেল ও চালের গুড়া দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী পিঠা ইত্যাদি।[৩]

পুঁথিপাঠ: আমাদের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি

প্রাচীন বাংলায় ঈদের অন্যতম আকর্ষণ ছিল পুঁথিপাঠ—পুঁথি সাহিত্য থেকে নির্দিষ্ট সুরে আবৃত্তি। এই পুঁথিগুলো শুধু কবিতা ছিল না, বরং এগুলো ইসলামী ইতিহাস ও স্থানীয় লোককথার সমন্বয়ে রচিত মহাকাব্য।

পুঁথিপাঠ একটি শিল্প। পুঁথিপাঠকদের সমাজে নামডাক ছিল। তাদের কণ্ঠের মাধুর্য, কাহিনির গভীরতা ও আবেগময় প্রকাশভঙ্গি আসরে উপস্থিত শ্রোতাদের মোহিত করত। গ্রামের চৌরাস্তা, বড় গাছতলা কিংবা কারও উঠানে এসব পুঁথিপাঠের আসর বসত। পুঁথিপাঠক মাঝখানে বসতেন, সকলে তাকে ঘিরে গোল করে বসত। গ্রামের স্নিগ্ধ সাঁঝে এই আবৃত্তি এক অনন্য আবহ তৈরি করত। ছোট-বড় সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই পুঁথিপাঠ শুনত। এটি শুধু বিনোদনের মাধ্যমই ছিল না, বরং এতে সমাজের নৈতিক শিক্ষা, ঐতিহাসিক ঘটনাবলি ও সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরা হতো।[৪]

খেলাধুলা

ঈদকে আরও উৎসবমুখর করতে বিভিন্ন খেলাধুলা ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। জনপ্রিয় খেলার মধ্যে ছিল—কাবাডি, কুস্তি, নৌকাবাইচ। এছাড়া কিশোরদের জন্য ছিল ঘুড়ি উড়ানোর খেলা। এই খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঘুড়ি কেটে ফেলা হলো মূল লক্ষ্য। মেয়েরা খেলত গোল্লাছুট, কানামাছি ইত্যাদি। তাছাড়াও বন্ধুদের সাথে বসে গল্প ও হাসির আসরও জমত।

এসব প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন গ্রাম একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত। এতে করে সুস্থ বিনোদন, সামাজিক সংহতি নিশ্চিত হতো। তাছাড়া ঈদকে ঘিরে গ্রামে গ্রামে মেলাও হতো। কিশোরদের জন্য ঈদ ছিল আনন্দ, খেলাধুলা ও সামাজিক মেলবন্ধনের সুযোগ। তরুণরাই স্থানীয় খেলাধুলা, মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত।

উত্তরাধিকার

প্রাচীন বাংলার ঈদ উদযাপন ছিল ধর্মীয় নিষ্ঠা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও সামাজিক সম্প্রীতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন।[৬। সময় বদলেছে, বদলেছে আমাদের জীবনযাত্রা, ঈদ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। তবে ঈদের মূল বার্তা রয়ে গেছে ভালোবাসা, দয়া ও ঐক্যের চিরন্তন প্রতীক হিসেবে। আমরা আবহমান কাল ধরে চলে আসা বাংলার এই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী।

রেফারেন্স- 

১. Eaton, Richard M. The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204–1760. University of California Press, 1993.

২. Sarkar, Jadunath. History of Bengal: Muslim Period, 1200–1757. University of Dacca, 1948.

৩. Sen, Dinesh Chandra. Folk Literature of Bengal. University of Calcutta, 1920.

৪. Ahmed, Rafiuddin. The Bengal Muslims 1871–1906: A Quest for Identity. Oxford University Press, 1981.

৫. অনেক সময় ঈদ উদযাপনের নামে অনৈসলামিক কিছু কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এগুলোকে আমরা ঐতিহ্য হিসেবে পালন করা থেকে বিরত থাকব। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তোমরা তার অনুসরণ করো, তখন তারা বলে, বরং আমরা তারই অনুসরণ করব যার ওপর আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছুই জ্ঞান রাখত না এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত ছিল না।’ (সূরা বাকারাহ, ১৭০)

[ষোলো ঈদ সংখ্যা ২০২৫ এ প্রকাশিত]