বৈদ্যুতিক শক কমবেশি আমরা সবাই খেয়েছি। কিন্তু কখনো কি শুনেছ, কোনো মানুষের শরীর থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়েছে? শুনলে তোমরা চমকে উঠতে পারো যে, আমার সাথেই এমনটা হয়েছে। আজ তোমাদেরকে সেই গল্প বলব।

এক বিকেলের কথা। আমি ছিলাম তখন কারাতে ক্লাসে। সেদিন সূর্য অনেক বেশি তেজ দেখাচ্ছিল। উত্তেজনায় মেতে কসরত করছিলাম, কিন্তু পানি কম খাওয়ার বদভ্যাসের কারণে দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। বিরতির সময় ব্যাগ থেকে পানি আনতে গিয়ে দেখি, আমার সহপাঠী মাসুদ আমার ব্যাগের সামনে বসে পানি খাচ্ছে। এবং অনেক বলার পরও সরছে না। রাগটা সামলে রেখে ওকে হালকা করে শুধু একটা চাপড় দিলাম। কিন্তু এই চাপড় ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে রহস্যময় চাপড়!

হঠাৎ যেন দু’জনেই এক বৈদ্যুতিক শক খেলাম!

মাসুদ আমার থেকে দূরে সরে গেল। কিন্তু এটা কী ঘটল!

আমরা কিছুই বুঝলাম না। আমাদের এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখে ইবরাহীমের আগ্রহ জাগল। কী চলছে তা জানতে চাইল। কিন্তু ওর আগ্রহ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। সেও ঝাড়া খেল এবং দূরে সরে গেল। মাসুদ পরে বলা শুরু করল, ‘সবাই ওর থেকে দূরে থাক। ওর শরীর থেকে কারেন্ট আসছে!’

প্রথমে কেউ বিশ্বাস করছিল না, কিন্তু একের পর এক কয়েকজন আমাকে ছুঁতে আসলে তারাও শক খেয়ে দূরে সরে গেল। তাদের বিস্মিত মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, আমার শরীরে কোনো এক অলৌকিক শক্তি কাজ করছে। মজা পেয়ে আরও একবার ইবরাহীমকে ছোঁয়া দিতে গেলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তখন আর কোনো শক হলো না।

বাসায় ফিরে এই অভিজ্ঞতার কথা আব্বুকে জানাতেই তিনি বললেন, তিনিও নাকি একদিন এমন শক খেয়েছিলেন আমার কাছ থেকে, কিন্তু এটাকে ভুল ভেবেছিলেন। আমার কথা শোনার পর তিনি বুঝলেন যে, ওটা সত্যিই বৈদ্যুতিক শক ছিল। এবার আমি ভাবতে লাগলাম, মনে হয় সত্যিই আমার মধ্যে বিশেষ এক শক্তি আছে।

বিশাল ফ্যান্টাসির জগতে ডুবে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এ সুপারপাওয়ার বোধহয় আর যাবে না। মনে হচ্ছিল কোনো গুন্ডা এসে আমার সামনে ছুরি ধরলে তাকে আমি কারেন্টের শক খাইয়ে দিব। সবাই আমাকে চিনবে “বৈদ্যুতিক মানব” নামে!

উপরের ঘটনা পড়ে তোমাদের নিশ্চয় খুব মুগ্ধতা কাজ করতে পারে যে, ‘ইশ! আমি যদি বৈদ্যুতিক মানব হতাম!’ দাঁড়াও, এখনই মুগ্ধতা নাই করে দিচ্ছি…

পরবর্তী দিনগুলোতে এই রহস্য ভেদ করার আগ্রহ বেড়ে গেল। শিক্ষকদের এবং ইন্টারনেটের সাহায্যে অবশেষে জেনে গেলাম, এটি আসলে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি বা স্থির বিদ্যুৎ। আমাদের চারপাশের প্রতিটি বস্তুতে ইলেকট্রন থাকে, মানুষের শরীরেও। তবে ঘর্ষণের কারণে ইলেকট্রন বেশি হয়ে গেলে শরীরে সাময়িকভাবে বৈদ্যুৎ সৃষ্টি হয়। যখন দুটি পদার্থ পরস্পরের সাথে ঘষা খায়, তখন একটির ইলেকট্রন অন্যটিতে চলে যায়। বেলুন চুলের সাথে ঘষলে যেমন চার্জ হয়, তেমনই আমাদের শরীরেও ইলেকট্রন জমা হতে পারে। একে বলে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, মানুষের শরীরে Static Electricity কীভাবে তৈরি হয়? দেখো, কীভাবে হয়:

  1. কাপড়ের ঘর্ষণ: যদি তুমি নাইলন বা ঊলের তৈরি কাপড় পরে অনেক নড়াচড়া করো, তাহলে কাপড়ের ঘর্ষণে ইলেকট্রন শরীরে জমা হয়ে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি তৈরি হতে পারে। 
  2. শুষ্ক আবহাওয়া: আর্দ্র আবহাওয়ায় ইলেকট্রন বাতাসের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। তবে শুষ্ক আবহাওয়ায় ইলেকট্রন সহজে বের না হওয়ায় শরীরে জমা থাকে। এতে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি তৈরি হয়।
  3. বিছানার চাদর: যখন তুমি শুষ্ক আবহাওয়ায় সিন্থেটিক চাদরে ঘুমাও এবং এপাশ-ওপাশ করো, তখন ঘর্ষণের কারণে তোমার শরীরে ইলেকট্রন জমে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি তৈরি হতে পারে।

এই শক সাধারণত ক্ষতিকর নয়। তবে কিছু পরিস্থিতিতে এটি বিপজ্জনক হতে পারে। যেমন, গ্যাস লিক থাকলে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটির স্ফুলিঙ্গের কারণে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তাছাড়া কিছু ইলেকট্রনিক ডিভাইস স্ট্যাটিক ডিসচার্জের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

তাই সতর্ক থাকতে হবে—

  • গ্যাস লিক হলে যেকোনো ধরনের স্পার্ক বা আগুন থেকে দূরে থাকতে হবে।
  • স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি থেকে যে স্পার্ক হয়, তা থেকেও সাবধান থাকতে হবে।
  • প্রাকৃতিক সুতা দিয়ে তৈরি কাপড় পরলে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি কম উৎপন্ন হয়, তাই সুতি পোশাক পরতে হবে।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই তোমরা স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি এবং এর প্রভাব সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছ।  

এসো, এবার হিসেব মিলাই। আমার কারাতে ক্লাসের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারলাম, ক্লাসের রাবার ফোমের ম্যাটের কারণে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি তৈরি হয়েছিল। আমি যখন দ্রুত নড়াচড়া করছিলাম, তখন ইউনিফর্ম ও ম্যাটের ঘর্ষণে আমার শরীরে ইলেকট্রন জমে যায়। রাবার ফোম বিদ্যুৎ অপরিবাহী হওয়ায় এই ইলেকট্রন মাটিতে চলে যায়নি; বরং আমার শরীরে থেকে গিয়েছিল। তাই মাসুদকে চাপড় দেওয়ার সাথে সাথে আমার শরীরের অতিরিক্ত ইলেকট্রন তার শরীরে চলে যায় এবং সে বিদ্যুতের শক পায়। এটাই স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি ছিল।

আল্লাহ আমাদের শরীর ও পরিবেশে কত অজানা রহস্য রেখেছেন! আমরা বলি এগুলো নাকি বিজ্ঞান, বিজ্ঞানিরাই নাকি বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু শরীরের ভেতর এই বিদ্যুৎ কোন বিজ্ঞানী আবিষ্কার করলেন? কোন বিজ্ঞানী বস্তুর মধ্য থেকে ইলেকট্রন শরীরে ট্রান্সফার করে দিলেন? এই ইলেকট্রনই বা কে বানালেন? ক্ষুদ্র থেকে বড়, দৃশ্যমান বা অদৃশ্য—বিজ্ঞান এগুলো ব্যাখ্যা করতে পারে; তবে এর সৃষ্টিকর্তা তো একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা।

আল্লাহ তাআলার এসব বৈচিত্র্যময় সৃষ্টির রহস্য নিয়ে গবেষণা করতে করতে আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে, তবুও এই রহস্যের শেষ হবে না। শুধু মানুষের শরীরের মধ্যেই আল্লাহ তাআলা কত রহস্য দিয়ে রেখেছেন। অথচ আমাদের মন-মস্তিষ্কের বাইরেও এই সৃষ্টিজগতের কতকিছুই আমাদের অজানা রয়ে গেছে।

বৈদ্যুতিক মানব হওয়ার রহস্য বের করতে গিয়ে আল্লাহর সৃষ্টি মানব শরীর সম্পর্কে অজানা বিষয় জানতে পারলাম। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদেরকে তাঁর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করার দ্বারা তাঁকে আরও বেশি করে চেনার তৌফিক দান করুন। আমীন।

[ষোলো জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত]