প্রিয় ভাইয়া-আপুরা, তোমাদের মনে কি কখনো প্রশ্ন জেগেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কুরবানি কিংবা অন্য যেকোনো উৎসব-অনুষ্ঠানগুলো কেন গরু জবাইয়ের মাধ্যমেই আয়োজন করা হয়? এই অঞ্চলে গরুর সহজলভ্যতাই কি এর একমাত্র কারণ? নাকি মুদ্রার অপর পিঠেও কোনো রহস্য আছে?
চলো, অতীত থেকে একবার ভ্রমণ করে আসি।
১.
১১৪২ খ্রিষ্টাব্দ। সুদূর আরবের মাটি তায়েফ থেকে এই বাংলায় ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগমন করেন বাবা আদম শহীদ রহিমাহুল্লাহ। সে সময়ে তৎকালীন বিক্রমপুরের (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) ক্ষমতায় ছিল সেন রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা বল্লাল সেন। বাবা আদম শহীদ দ্বীন প্রচার আরম্ভ করা শুরু করলে একটি গরু জবাইকে কেন্দ্র করে তাঁর সাথে বিরোধ বাঁধে বল্লাল সেনের কর্মচারীদের। এরই সূত্র ধরে বাবা আদম শহীদের সাথে বল্লাল সেনের যুদ্ধ শুরু হয়। ১১৭৪ সালে বিক্রমপুরের কানাইচং ময়দানে বল্লাল সেনকে পরাস্ত করেন আদম শহীদ রহিমাহুল্লাহ। কিন্তু তার চার বছর পরে বল্লাল সেন আবারও আক্রমণ করে বসে। এবারও নাকানিচুবানি খেয়ে পরাজিতশক্তি বেছে নেয় বিশ্বাসঘাতকতার পথ। রাতের আঁধারে হত্যা করে বাবা আদম শহীদকে। রহিমাহুল্লাহ।
কিন্তু এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে মুসলিমদের চেতনা ও সংস্কৃতিকে নির্মূল করা যায়নি। মুন্সিগঞ্জ ঠিকই বিজিত হয়েছিল, ইসলাম ঠিকই স্থানলাভ করেছিল সেখানে।
২.
১৩০৩ সাল। সিলেটকে তখন ডাকা হতো শ্রীহট্ট। ইসলামী শাসনব্যবস্থা তখনো সেখানে প্রতিষ্ঠা পায়নি। কট্টর হিন্দু গৌড় গোবিন্দ ছিল সেখানকার রাজা। তবুও নামেমাত্র কিছু মুসলিম সেখানে বাস করতেন। তাদেরই মধ্যে একজন ছিলেন শেখ বুরহানউদ্দীন। বুরহানউদ্দীনের কোনো সন্তান ছিল না। আল্লাহর কাছে অনেক কান্নাকাটির পর তার দুআ কবুল হয়। একটি পুত্রসন্তান লাভ করেন তিনি। সন্তানের আকীকার জন্য একটি গরু জবাই করলেন বুরহানউদ্দীন। আশেপাশের প্রতিবেশী ও আত্মীয়দেরকেও গরুর মাংস বিলি করলেন। কিন্তু এই খবর পৌঁছে যায় গৌড় গোবিন্দের কানে। নিজের রাজ্যের প্রজা গরু জবাই করবে এটা মেনে নিতে পারল না গোবিন্দ। শাস্তিস্বরূপ বুরহানউদ্দীনের পুত্রসন্তানকে হত্যা করা হলো আর বুরহানউদ্দীনের ডান হাত কেটে ফেলা হলো।
পুত্রসন্তানকে হত্যার দায়ে বিচারের জন্য বুরহানউদ্দিন হাজির হলেন তৎকালীন বাংলার শাসক শামসউদ্দীন ফিরোজ শাহের নিকট। ক্ষোভে উত্তেজিত সম্রাট তারই ভাগ্নে সিকান্দার গাজীকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রেরণ করলেন। কিন্তু তার সৈন্যরা ব্রহ্মপুত্র নদী পার হতে যেয়ে বারংবার ব্যর্থ হচ্ছিল। কারণ গোবিন্দ সেখানে জাদুমন্ত্রবলে প্রতিরোধ তৈরি করে রেখেছিল।1 সিকান্দার গাজীর ব্যর্থতার খবর পৌঁছে যায় দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দিন খলজীর কাছে। আলাউদ্দীন এ সংবাদ শুনে তারই দরবারের একজন বুযুর্গ ব্যক্তি সৈয়দ নাসির উদ্দীনকে সিলেট অভিযানের জন্য প্রেরণ করেন। এরই মাঝে বুরহানউদ্দীন সাক্ষাৎলাভ করেন বিখ্যাত দরবেশ শাহজালালের। তার কাছে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেন বুরহানউদ্দীন। এটা শুনে শাহজালাল রহিমাহুল্লাহ তৎক্ষণাত বেরিয়ে পড়লেন তার সাথে থাকা সঙ্গীদের নিয়ে। পথিমধ্যেই তাদের সাথে দেখা হয়ে যায় সৈয়দ নাসির উদ্দীনের। এবার একত্রিত হয়ে সবাই যাত্রা করলেন সিলেট অভিমুখে।
তাদের আগমনের খবর পেয়ে গৌড় গোবিন্দ ব্রহ্মপুত্র নদের সকল নৌ চলাচল বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ঈমানের বলে বলীয়ান শাহজালাল ও তাঁর সঙ্গীরা এতে দমে যাননি। আল্লাহর সাহায্যে তারা নদী পার হয়ে সিলেট প্রবেশ করেন। ইতোমধ্যে সেই খবর পেয়ে গৌড় গোবিন্দ পলায়ন করে। সিলেট প্রবেশ করেই শাহজালাল রহিমাহুল্লাহ সর্বপ্রথম আযান দেন। এভাবেই সিলেটে ইসলাম বিজয় লাভ করে। অবসান হয় গরু জবাইকে কেন্দ্র করে ঘটা নির্মম জুলুম ও গৌড় রাজ্যের।
৩.
এই অঞ্চলে যখন ব্রিটিশরা ক্ষমতায় ছিল, তখন তাদেরই ছত্রছায়ায় গড়ে উঠতে থাকে একদল হিন্দু জমিদারশ্রেণি। ধীরে ধীরে এসকল জমিদাররা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখানো শুরু করে দুর্বল-অসহায় মুসলিমদের উপর। সেসময় পুরো মুসলিম সমাজই এসব জমিদারদের দ্বারা নিগৃহীত, নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত হচ্ছিল। জমিদারদের প্রবল আধিপত্যের জোরে তাদের উপর নেমে আসে অত্যাচার, জুলুম ও শোষণের স্টিমরোলার। শুধু তাই নয়, সদ্য ভূমিষ্ঠ নবজাতকের ইসলামী নাম রাখা, দাড়ি রাখা, ইসলামী পোশাক পরিধান করা, কুরআন ও দ্বীনি শিক্ষা প্রদান, আযান দেওয়া ও জামাআতে সালাত আদায় করা, গরু জবাই করার মতো ইসলামী বিধিবিধান ও রীতিনীতির উপর আরোপিত হয় জরিমানা, কঠোর শর্ত, সামাজিক অবহেলা এবং নিষেধাজ্ঞা।
তাদের এমন বর্বরতার বিরুদ্ধে যেই ব্যক্তি আওয়াজ তোলেন এবং এগিয়ে আসেন তিনি হলেন সাইয়েদ মীর নিসার আলী তিতুমীর রহিমাহুল্লাহ। তিতুমীর ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা ও হিন্দু জমিদারদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
তাঁর সময়ে এমনই এক জমিদার ছিল কৃষ্ণদেব রায়। সেও মুসলমানদের দ্বীন পালন করাকে কঠিন করে দেওয়ার মতো কাজগুলোর ব্যতিক্রম করেনি। তখন মুসলিমরা সন্তানের ইসলামী নাম রাখতে পারত না, দাড়ি রাখতে পারত না। এজন্য জমিদারকে মোটা অংকের কর দিতে হতো। মুসলিমদের বাধ্যতামূলক ধুতি পরতে হতো। এসব অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে ১৮৩১ সালের ৬ অক্টোবর কৃষ্ণদেবের বাড়িতে আক্রমণ করে তিতুমীরের বাহিনী। কিন্তু বাড়ির ছাদ থেকে ক্রমাগত ইট নিক্ষেপ করায় খুব বেশি সুবিধা করে উঠতে পারেনি তিতুমীরের বাহিনী। এরপরেও প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে বারোয়ারী তলার মন্দিরে তিতুমীরের দল একটি গরু জবাই করে এবং রক্ত মন্দিরে নিক্ষেপ করে। তিতুমীরের এই আন্দোলন পরবর্তীতে বাংলায় ইসলামী পুনর্জাগরণে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল।
আলোচ্য তিনটি ঘটনা থেকেই আমরা দেখতে পেলাম, আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে গরু জবাই নিছক কাকতালীয় কোনো ঘটনা ছিল না। বরং গরু জবাইয়ের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রাণ দিতে হয়েছে বারবার। গরু জবাই করতে পারার এই আন্দোলন সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ের পাশাপাশি আমাদের ইসলামী সংস্কৃতি, চেতনা ও ঐতিহ্যের প্রতীকও বটে। বিরোধী শক্তি এখনো তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছর রমাদানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে গরুর মাংস নিষিদ্ধ করা হয়। আন্দোলনের মাধ্যমে আবার হলে গরুর মাংস খাওয়ার অধিকার আদায় করতে হয়। আমাদের পাশের দেশ ভারতের মুসলিমদের সেই অধিকারটুকুও নেই। গরু খাওয়ার কারণে তাদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ঈদুল আযহায় গরু কুরবানি দিতে পারে না তারা। নিজ দেশেই তারা আজ পরবাসী। আমাদের মুসলিম পরিচয় ও গরু খাওয়ার অধিকার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই অধিকার আদায়ের জন্য আজও রক্ত দিয়ে যাচ্ছে আমাদের মুসলিম ভাইবোনেরা। তাই পরেরবার চালের রুটির সাথে গরুর গোশত মুখে নেওয়ার আগে আমাদের গৌরবময় বীরত্বগাঁথা ও লড়াইকে ভুলে যেয়ো না কিন্তু!

রেফারেন্স:
১. আবুল কাশেম ভুঁইয়া (১৯৮৭), উপমহাদেশে মুসলিম পুনর্জাগরণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
২. মুনাওয়ার হাসনাইন. (২৭ জুন, ২০২৩). গরু জবাই : মুসলমানদের কালচারাল আইডেন্টিটি, আলাপন ব্লগ. https://tinyurl.com/57a223ns
৩. দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস. (৯ মার্চ, ২০২৪), সিদ্ধান্ত বদল, রমজানে রাবির হলে চলবে গরুর গোশত. https://tinyurl.com/39c8pkhc
৪. দৈনিক ইনকিলাব, (১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪), ভারতে গরুর গোশত খাওয়ায় মুসলিম যুবককে পিটিয়ে হত্যা. https://tinyurl.com/2h28n7pt
৫. Jain, M. (2014, November 11). Ban on cow slaughter in 24 Indian states is leading to dead humans on the border. Scroll.in. https://tinyurl.com/y6njxmpf
[ষোলো মে-জুন ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত]