আমরা দেখেছি, ‘১৮ এর নিরাপদ সড়ক আন্দোলন বা ‘২৪ এর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়গুলোতে দেশের বীর সন্তানেরা কীভাবে সাগ্রহে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে সড়ক ও যানবাহন-ব্যবস্থার নিরাপত্তার সাথে নিজেদের যুক্ত করেছিল। তাদের অংশগ্রহণ এবং সড়ক-অনিয়ম নিয়ে অফিস কলিগদের সাথে বিভিন্ন সময়ের কথাবার্তা আমাকে সড়ক নিরাপত্তার গুরুত্ব ও নিরাপদে সড়ক ব্যবহারে তরুণ প্রজন্মের দায়িত্ববোধ নিয়ে কিছু লিখার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। গত পর্বের (‘সড়ক নিরাপত্তা: কেন আমাদের সচেতনতা দরকার’, ষোলো ৮ম সংখ্যা)[১] মতো এবারও চেষ্টা থাকবে রসকষহীন আলোচনাগুলো সাবলীল রাখার।
আমরা প্রতিদিন নানা প্রয়োজনে সড়কে যাতায়াত করি—স্কুল, কলেজ, কোচিং, ব্যবসা-চাকরি বা আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা করা। যাওয়া-আসা করা হয় হেঁটে, কখনো বাসে/রিকশায়/গাড়িতে, আবার কখনো মোটরবাইক/সাইকেল/গাড়ি চালিয়ে। এ সড়কে নিরাপদে চলাচল করতে আমরা কে না চাই? সমস্যা হলো, নিরাপদে থাকতে চেয়েও আমাদের অবহেলা, অসতর্কতা, তাড়াহুড়োর মনোভাব; যা প্রভাব ফেলে বাকি সবার উপর। একটু চিন্তা করলেই ব্যাপারটা ধরতে পারবে। যখন তুমি ড্রাইভিং সিটে বসো, গাড়ির গতি বাড়াতে-কমাতে বা ডানে-বামে সরাতে দেখবে কতকিছুই বিবেচনা করতে হয়—বাকি গাড়িগুলোর মুভমেন্ট, ‘বামে পেলাশটিক’ বলতে বলতে চেপে আসা বাস, উল্টাদিক(!) থেকে আসা রিকশা মামা বা বাইকার ভাইয়াদের ‘সাইড দেন, সাইড দেন’ ইঙ্গিত, ধুমধাম হাত বাড়িয়ে পথচারীদের রাস্তা পারাপার ইত্যাদি। ঠিক একইভাবে পথচারীদেরও আছে নিজস্ব দাবিদাওয়া। যখন সড়ক ব্যবস্থার নিয়ম-কানুনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সবাই নিজ-নিজ দৃষ্টিভঙ্গি বা ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে চলতে চায়, তখনই বাধে বিপত্তি এবং তা রূপ নেয় দুর্ঘটনায়। মোদ্দাকথা, আমাদের সড়কে সচেতনতা শুধু নিজেদেরই উপকার করবে না, বাকিদেরও চলাচল সহজ করতে সহায়ক হবে, ইনশাআল্লাহ। আজ আমরা জানব, পথচারী ও চালক—প্রত্যেকেরই নিজ নিজ জায়গা থেকে সাবধান থাকতে কী কী করণীয় আছে।
সবার জন্যই অবশ্যকরণীয়:
প্রথম কাজ: বাসা থেকে বের হবার আগে আমাদের রব আল্লাহর কাছে নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সোপর্দ করা। আনাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বলবে,
بِسْمِ اللّٰهِ، تَوَكَّلْتُ عَلَى اللّٰهِ، وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللّٰهِ
অর্থ: আল্লাহ্র নামে (বের হচ্ছি)। আল্লাহর উপর ভরসা করলাম। আর আল্লাহর সাহায্য ছাড়া (পাপ কাজ থেকে দূরে থাকার) কোনো উপায় এবং (সৎকাজ করার) কোনো শক্তি কারও নেই।
তাঁকে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) বলা হবে: তোমার আর কোনো চিন্তা নেই, তোমার সকল দায়িত্ব গ্রহণ করা হলো, (তোমাকে সঠিক পথ দেখানো হলো) এবং তোমাকে হিফাজত করা হলো। আর শয়তান তার থেকে দূরে চলে যায়।[২]
দ্বিতীয় কাজ- সড়কে পা রাখার পর থেকে কুল মুডে চলে যাওয়া। মানে নিজের মেজাজকে শান্ত রেখে ধীরস্থিরভাবে গন্তব্যের পানে চলা। কোনো কাজে তাড়াহুড়ো করা শয়তানের বৈশিষ্ট্য[৩] এবং অধিকাংশ দুর্ঘটনা শুরু হয় অধৈর্য ভাব থেকে।[৪]
তৃতীয় কাজ- রাস্তায় চলাফেরা করা অবস্থায় মুঠোফোন ব্যবহার কোরো না। খুব জরুরি কল করতে বা রিসিভ করতে হলে রাস্তা থেকে একপাশে সরে গিয়ে থেমে প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে নাও।
যখন তুমি পথচারী:
- রাস্তা পার হবার সময় চেষ্টা করো জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ বা ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবহার করতে।
- একা না, কয়েকজন মিলে একসাথে রাস্তা পার হও। বিশেষ করে বড় রাস্তায়, যেখানে এক পাশ থেকে অপরদিকে যেতে ৪ বা তার চেয়ে বেশি লেন পার হতে হয়।
- রাস্তা পার হবার সময় ধুপধাপ চলে যেয়ো না। থামো, গাড়ি-(ঘোড়া!)র গতি বোঝার চেষ্টা করো। প্রয়োজনে হাতের ইশারায় এবং ড্রাইভারের সাথে চোখাচোখি (eye-contact) করে বোঝাও যে তুমি রাস্তা পার হতে চাচ্ছো, এরপর সিদ্ধান্ত নাও।
- রাতে বা কম আলোতে হাঁটার সময় উজ্জ্বল ও প্রতিফলক পোশাক (Reflective Vest) পরতে পারো, যাতে দূর থেকে চালকেরা তোমাকে সহজেই দেখতে পায়। ভেস্ট পরতে না চাইলে রিফ্লেক্টিভ ব্যাকপ্যাক বা স্টিকার ব্যবহার করো।
- কানে হেডফোন লাগিয়ে রাস্তায় চলাফেরা করবে না। গান শুনতে শুনতে ট্রেন/বাস চাপায় মৃত্যু – দুনিয়ার জীবনের শেষ পরিণতি এমন অপমানকর হোক তা নিশ্চয়ই আমরা চাই না। আল্লাহ হিফাজত করুক।
- তোমাদের সাথে শিশু থাকলে তাদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখো। তাদের হাত ভালোমতো ধরে এমনভাবে রাস্তায় হাঁটবে যাতে বাচ্চা হঠাৎ দৌড়ে গাড়ির সামনে না যায় বা গাড়ি তাকে সরাসরি ধাক্কা দিতে না পারে।
যখন তুমি চালকের আসনে:
- যাত্রার শুরুতে বাহনে আরোহণের দুআ পড়তে ভুলে যেয়ো না-
سُبْحَانَ الَّذِيْ سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِيْنَ وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُوْنَ
অর্থ: সকল পবিত্রতা ঐ মহান সত্তার যিনি আমাদের জন্য বশীভূত করেছেন একে, অথচ আমরা সক্ষম ছিলাম না একে বশীভূত করতে, আর অবশ্যই আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করব।[৫]
- ট্রাফিক সিগন্যাল (বা পুলিশের হাতের ইশারা), ট্রাফিক সাইন, লেন নির্দেশিকা মেনে চলো।
- গতি নিয়ন্ত্রণে রাখবে। ড্রাইভিং/সাইক্লিং করার সময় সামনের গাড়ির সাথে পর্যাপ্ত স্পেস বজায় রাখো, যাতে সে হঠাৎ হার্ডব্রেক করলে তুমি নিজেকে সামলে নিতে পারো।
- সাইকেল বা বাইক চালানোর সময় অবশ্যই হেলমেট ব্যবহার করবে। রাতের যাত্রায় Reflective Vest পরবে।
- ওভারটেক বা অন্য রাস্তায় যাওয়ার জন্য লেন পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে আগে থেকেই সময় নিয়ে আস্তে আস্তে সরতে থাকো। ইশারা, ইন্ডিকেটর এবং হর্ন-এর মাধ্যমে অন্যদেরকে সতর্ক করো।
- যানবাহনের ব্রেক, টায়ার, ইঞ্জিন/চেইন, লাইট ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়মিত পরীক্ষা করো।
আমি জানি, তোমরা এ কথাগুলো এর আগেও অনেকবার শুনেছ, তাও লিখলাম যেন ভুলে না যাও! নিয়ম মানতে হবে - সড়ক নিরাপত্তায় এর বিকল্প কিছু নেই। এখন হয়তো বলবে, ‘সবাই তো এগুলো মানে না, আমি একা সাধু সেজে কী লাভ!’ লাভ আছে… তুমি-আমিই এই সমাজের প্রতিনিধিত্ব করি। আমরা শুরু করি, বাকিদেরও বোঝাতে থাকি। হ্যাঁ এটাও ঠিক, শুধু কিছু সচেতনতার বাণী শোনানো যথেষ্ট না, সাথে প্রয়োজন আইন প্রয়োগ, শাস্তির ভয় (enforcement induced awareness campaign), এবং গণমুখী নগর পরিকল্পনা (people-focused urban planning)। ঠিক যেমন আমাদের সমগ্রিক দ্বীন। আল্লাহর হুকুম নবিজির (ﷺ) সুন্নত মোতাবেক মানলে সবার জন্যই আছে শান্তি, সফলতা, কামিয়াবি - দুনিয়া ও আখিরাতে দুই জগতেই। এখন কেউ যদি তা না চায়, তাহলে সে নিজেকে যেমন বড় বিপদে ফেলছে, বাকি সবাইকেও তার প্রভাব ও ক্ষমতাবলে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সমাজকে কল্যাণের উপর রাখতে তাই রয়েছে আল্লাহর আইন, কিছু কঠোরতা।
[১] গত পর্ব পড়ে নাও এখান থেকে - https://sholo.org/road-safety-01
[২] সুনানে আবু দাঊদ, হাদীস নং ৪/৩২৫; সুনানে তিরমিযি, হাদীস নং ৫/৪৯০
[৩] সাহল ইবনে সা'দ আসসায়েদী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন, ‘ধীরস্থিরতা আল্লাহর পক্ষ হতে; আর তাড়াহুড়া শয়তানের পক্ষ হতে।‘ — সুনানে তিরমিযি, হাদীস নং ৫০৫৫। তাঁর মতে, হাদীসটি গরীব সনদের।
[৪] McCarty, D., & Kim, H. W. (2024b). Risky behaviors and road safety: An exploration of age and gender influences on road accident rates. PLoS ONE, 19(1), e0296663. https://doi.org/10.1371/journal.pone.0296663
[ষোলো মে-জুন ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত]
[৫] সূরা যুখরুফ, আয়াত ১৩-১৪