১৮ জুলাই, ২০২৪
অন্যান্য দিনগুলোর মতো আমরা জড়ো হয়েছি যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে; বসুন্ধরা গেইটে। তবে সেদিন আগে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির আট নম্বর গেইটে জড়ো হই। সেখানে এআইইউবি ও আইইউবি’র ভাইরাও এসেছিল। সেখান থেকে দল বেঁধে যাই যমুনার সামনে। কেননা আগের রাতেই খবর পেয়েছিলাম যে, যমুনার সামনে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আন্দোলনকারীদের দেখলেই গুলি চালানোর অর্ডার আছে। তখন সকাল ৯/১০টা হবে।
যমুনার সামনে যাওয়ার পরে স্লোগান শুরু হলো। সেখানে থাকা পুলিশদের ‘ভুয়া, ভুয়া’ বলে স্লোগান দিতে লাগল ছাত্ররা। তোপের মুখে সেখান থেকে এপিসি নিয়ে ধীরে ধীরে সরে গেল পুলিশ। তারপরে সেখানেই অবস্থান নিল ছাত্ররা। মেয়েদেরকে মাঝখানে রেখে চারপাশ থেকে প্রোটেকশনে ছিল ছেলেরা।
এর মধ্যে আন্দোলনে এসে যুক্ত হলো ভিকারুননিসা স্কুলের বসুন্ধরা শাখার ছোট ছোট মেয়েরা। তারা আসলেই স্লোগান বেড়ে গেল। ছোট বোনদের এমন সাহসিকতা আর আবেগ অন্যরকম একটা সাহসের পরিবেশ তৈরি করে পুরো জমায়েতে।
হঠাৎ করে খবর আসলো, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি চালানো শুরু করেছে পুলিশ। সাথে সাথেই নতুনভাবে জেগে উঠল সবাই। রাগে-ক্ষোভে যেন ফেটে পড়ল। এখনের মিশন - মার্চ টু ব্র্যাক। ভিকারুননিসার ছোট বোনদেরকে এখানে রেখে কিছু ছাত্র জায়গাটা দখলে রাখার জন্য থেকে যায়। বাকিরা পায়ে হেঁটে রওনা দেয়। তখন ছাত্রদের সাথে ছিলেন নর্থ সাউথের শিক্ষক ববি হাজ্জাজ।
পথে যাচ্ছি। কারও হাতে লাঠি আছে, কারও হাতে নেই। পথে দেখলাম এক দিনমজুর আঙ্কেল লোহার রড কেটে সবাইকে দিচ্ছেন। আমিও একটা নিলাম। হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে গেলাম আরও তিনটা লাঠি। দুইটা দুইজন ছাত্রকে দিয়ে দিলাম। পথে গাছের সাথে লাগানো লাঠি, তক্তা কেটে লাঠি বানিয়ে নিচ্ছিল আন্দোলনকারীরা।
যেতে যেতে রামপুরা ব্রীজের কাছে আসতেই দেখি অনেক পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে বাম দিকের গলিতে ছাত্রলীগ। সব হেলমেট পরা। ছাত্ররা এগিয়ে যেতেই হঠাৎ টিয়ারশেল নিক্ষেপ শুরু করল পুলিশ। রিফাত ভাই বলল, একটু দূরে দাঁড়াই। বাতাসে মিশে গেলে সমস্যা হবে না। কিন্তু না, ভাই ভুল বুঝেছিলেন। সমস্যা হলো। বাতাসে মিশে গিয়েও লাভ হলো না।
জীবনে প্রথমবারের মতো টিয়ারশেলের মুখোমুখি হওয়া। প্রচণ্ড বাজে রকমের অনুভূতি। সে সময় মনে হচ্ছিল শত্রুরও যেন এমন কষ্ট না হয়। মুখ ছিলে যাচ্ছিল যেন। চোখ খোলা যায় না জ্বালাপোড়ায়। মনে হয় মুখে যেন কেউ কেরোসিন লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। দৌড়ানো দরকার ছিল। কিন্তু সেটাও করা যাচ্ছিল না। কেননা চোখও খোলা যাচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে কী দৌড়ানো যায়!
কিছুটা পেছনে সরে আসলাম। ব্যাগে পেস্ট নিয়ে এসেছিলাম। মুখে চোখে পেস্ট লাগিয়ে অন্যদেরকে সেটা দিয়ে দিলাম। জ্বালাপোড়া কিছুটা কমল। মোটামুটি সামলে নিয়ে ততক্ষণে রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়েছে ছাত্ররা। আগুনের ধোঁয়ায় শ্বাস নিলে কষ্ট কিছুটা কমে। একজন মজা করে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই এখন সিগারেট খাওয়া জায়িজ হবে?’
রাগে ভাঙচুর শুরু করল ছাত্ররা। রাস্তার ব্যারিয়ার ভেঙে লাঠি তৈরি করল। যে পাতগুলোয় এডভার্টাইজ লাগায়, সেটাতে জোরে জোরে আঘাত করে ভীতি সৃষ্টি করল পুলিশদের জন্য। আবার এগিয়ে গেল।
একটু পর পুলিশ গুলি শুরু করল। রাবার বুলেট নিক্ষেপ। বাম দিক থেকে ইট-পাটকেল ছুড়ছে ছাত্রলীগও। পেছন থেকে দুটো রাবার বুলেট এসে লাগে আমার মাথার পেছনে। দূর থেকে হওয়ায় কোনো মেজর ক্ষতি হয়নি, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু বেশ ব্যথা লেগেছিল। ব্যথায় মাথা ঘুরে বমি আসতে লাগল। কল দিলাম ভাইয়াকে, নাঈমকে। বললাম, গুলি শুরু হয়েছে। একজন আহত হয়েছে। দুআ করতে। ভাইয়া বলল, ‘আল্লাহ ভরসা। সেইফ থাকার চেষ্টা করো।’
ছাত্র তো হাজার হাজার। তাদের সামনে কত বুলেট ছুড়বে পুলিশ। তাই ওখানকার পুলিশরা এপিসিতে উঠে পালিয়ে গেল পাশের গলি দিয়ে। এবার ছাত্রলীগের দিকে তেড়ে গেল ছাত্ররা। সটকে গেল তারাও।
আবার আগালাম আমরা। এসে পৌঁছলাম কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ওখানে। সেখানে আবার কিছু পুলিশের সন্ধান মিলল। তারা প্রথমেই শুরু করল গুলি। ছাত্ররা এবার আর পিছিয়ে গেল না। এলাকার কিছু স্থানীয় ছেলে ও সাধারণ ছাত্ররা মিলে ইট-পাটকেল, লাঠি দিয়ে আক্রমণ চালালো ব্যাপকভাবে। কিছুক্ষণ পরে ধীরে ধীরে পিছিয়ে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে গেল পুলিশ।
এবার তো আটকা। ভার্সিটির বিল্ডিং ঘিরে ফেলল ছাত্ররা। শুরু হলো ব্যাপক ভাঙচুর। ছাত্ররা যেই ঢুকতে যাবে, অমনি গুলি-গ্রেনেড মারা শুরু করল পুলিশ। আহত হলো বেশ কয়েকজন। আমার সামনের জনের হাত ছিঁড়ে গুলি বের হয়ে গেল। কিন্তু তিনি হাসপাতালে যাবেন না বলে জানালেন। এবার রাস্তার পাশে লোহার যে পাতগুলোতে নানা এডভার্টাইজ লাগানো থাকে, সেগুলোকে শিল্ড বানিয়ে গেইটের একদম সামনে প্রতিরোধের জন্য রেডি হলো ৫-৬ জন। চলল লড়াই।
এদিকে যারা বাইরে আছি তাদেরকে একজন ভাই ডেকে ডেকে রাস্তার আইসক্রিমওয়ালা থেকে আইসক্রিম খাওয়ালেন। সাধারণ মানুষ। বললেন আপনারা যা ইচ্ছা খান। বিল নিয়ে চিন্তা করবেন না। এদিকে প্রচণ্ড রোদ, টিয়ারশেল, আগুনের উত্তাপে তৃষ্ণায় অবস্থা খারাপ। এক বোতল ঠান্ডা পানি পেলাম। কিন্তু কাছেই দেখলাম এক বোন অসুস্থ হয়ে গেছেন, বমি করছেন। পানিটা উনাকে দিয়ে দিলাম।
বেশ কয়েক প্যাকেট খিচুড়ি ভ্যানে করে এনে সাধারণ ছাত্রদের বিলি করলেন আরেক আঙ্কেল। এক ছোট ভাইয়া নিজের জমানো টাকা দিয়ে কোল্ড ড্রিংকস, চকলেট এনে দিচ্ছিল আমাদের। মানবতা, ঐক্য, ভালোবাসার এক অন্যরকম সংহতি দেখা গেল সেদিন।
ততক্ষণে আহতের সংখ্যা বাড়ছে। বারবার এম্বুলেন্স আসছে আর দুই-তিনজন করে আহতকে নিয়ে যাচ্ছে।
একপর্যায়ে ধীরে ধীরে পিছিয়ে গিয়ে ছাদে অবস্থান নিল পুলিশ। এ সুযোগে ঢুকে পড়ল ছাত্ররা। পেয়ে গেল দু’জন পুলিশকে। বাকিরা ছাদে। এ দু’জনকে ইচ্ছামতো পিটিয়ে অজ্ঞান আর মুমুর্ষ করে দেওয়া হলো। শুরু হলো তাকবীর স্লোগান। এদেরকে ইচ্ছামতো পিটিয়ে লাঠির আগায় ঐ পুলিশের জামা, জুতো নিয়ে বের হলো কয়েকজন ছাত্র। গুজব ছড়িয়ে পড়ল, মরে গেছে সে পুলিশ। সাথে সাথে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হলো পুরো জমায়েত।
বুঝতে পারলাম, আন্দোলন মোড় নিয়েছে পুরোপুরি অন্যদিকে। যখন প্রতিপক্ষকেও মেরে ফেলতে, সেটাকে সেলিব্রেট করতে শিখে যায় আন্দোলনকারীরা, তখন আন্দোলন ঘুরে গেছে। আন্দোলন আর কোটায় নেই, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের চাকরির সুযোগে নেই। এমনটাই হয়েছিল ফ্রেঞ্চ রেভোল্যুশনের ক্ষেত্রে। বাস্তিলের গভর্নরের মাথা শূলে চড়ানো দিয়ে শুরু হয়েছিল বিপ্লব।
পুলিশ মরেনি। কিন্তু অজ্ঞান-মুমুর্ষ হয়েছিল। তাকে পরে এম্বুলেন্সে তুলে দেয় সাধারণ ছাত্ররা।
কিছু ছাত্র ছাদে উঠতে চাইলেই গুলি করে পুলিশ। সাথে সাথে পড়ে যায় দুইজন ছাত্র। আল্লাহর রহমতে মারা যায়নি। এমন সময় র্যাবের হেলিকপ্টার আসা শুরু করে একে একে। ছাদ থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যায় পুলিশদেরকে। ব্র্যাকেও ততক্ষণে সংঘাত বন্ধ হয়ে এসেছে। সন্ধ্যার পরে আর থাকা যাবে না। শাপলার ঘটনা তো সবারই মনে আছে। তাই সেখান থেকে ধীরে ধীরে বসুন্ধরার দিকে ফিরতে থাকে ছাত্ররা।
পথিমধ্যে একজন এসে বলে, পাশের এক গলিতে ছাত্রলীগ দাঁড়িয়ে আছে। ছাত্ররা আক্রমণ করতে গেলে দেখা গেল কেউ নেই। যে এসে বলেছিল, সে আসলে ছাত্রলীগের ছিল অথবা সে ভুল দেখেছিল। এটা ছিল একটা ফাঁদ। বিল্ডিং এর উপর থেকে মুহুর্মুহু ইট ছুড়তে থাকে ছাত্রলীগের গুন্ডারা। কয়েকজন আহত হয়। কিছুক্ষণ পরে তারা পালিয়ে যায়।
যমুনার সামনে আসতেই আমাদের চেহারার অবস্থা দেখে আমাদেরকে দ্রুত খাবার পানি এগিয়ে দিল ওখানকার ভাইরা। তখন সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়। একটা বন আর স্যালাইন পানি খেলাম। সেখানে কার্টন কার্টন খাবার দিয়ে গিয়েছিল নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। শিক্ষক, অভিভাবক, রিক্সাওয়ালা। বিস্কুট, বন, পানি, স্যালাইন, কোল্ড ড্রিংকসসহ আরও নানাকিছু। আন্দোলনে একদিনও আমাদেরকে না খেয়ে থাকতে হয়নি।
সেদিনের মতো লাঠিটা রাস্তায় রেখে ঘরে ফিরে যাই।