ঈদ মানেই খুশি, সুস্বাদু খাবার, নতুন জামা, আত্মীয়স্বজনদের আনাগোনা আর… সালামি! হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ—ঈদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকগুলোর একটি হলো সালামি পাওয়া। সালাম দিয়ে ‘ঈদ মুবারক’ বললেই আত্মীয়রা হাসিমুখে হাতে ধরিয়ে দেন একদম টাটকা, কচকচে নতুন (অথবা পুরোনো) টাকার নোট। আর তার সাথে থাকে সেই চিরচেনা উপদেশ—’বাবা, সব টাকা একবারে খরচ করে ফেলো না!’ কিন্তু প্রতিবার তুমি তা-ই করো।

কেবল তোমার ভাগ্য বা নিষ্পাপ চেহারার ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে বেশি সালামি আসবে না। সালামি ম্যানেজ করা একটি শিল্প! যদি তুমি তোমার সালামি কালেকশন বাড়াতে চাও এবং চাও সেই টাকা বেশি দিন টিকে থাকুক, তবে এই ঈদ সালামি ম্যানেজমেন্ট গাইড তোমার জন্য!

ধাপ ১: সালামি সংগ্রহে পটু হও

সালামি সংগ্রহের সেরা কৌশল: ঈদের সালামি পাওয়ার জন্য শুধু মিষ্টি হাসি দিলেই হবে না, হতে হবে আরও স্মার্ট। শুধু ‘‘ঈদ মুবারক’’ বলে দায় সারলে হবে না, কথায় আনতে হবে মাধুর্য! চাচ্চুর সামনে গিয়ে একটুখানি আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলো, ‘চাচ্চু, আপনাকে কতদিন পর দেখলাম! কেমন আছেন?’—দেখবে পকেট থেকে টাকা নিজেই বেরিয়ে আসবে।

ভিআইপি সালামিদাতা চিহ্নিত করা: আত্মীয়দের সবাই সালামি দেওয়ার ব্যাপারে সমান উদার হয় না। সবার আর্থিক অবস্থাও সমান না। এটা বাস্তবতা। কেউ ২০ টাকা দেন, আবার কেউ আছেন ৫০০ টাকার নোট দিতে মোটেও সঙ্কোচ করেন না! আর যদি কেউ বিদেশ ফেরত হন (বিশেষ করে আরবের দেশগুলো থেকে) তাহলে নিশ্চিত থাকো—তিনি সোনার খনি! সালামি তিনি একটু বেশিই দিবেন। আর যারা বলেন, ‘আমাদের সময় ৫ টাকাই অনেক ছিল’, তাদের কাছ থেকে বেশি সালামি পাওয়ার তেমন আশা নেই।

পোশাকের জাদু: ভালো জামাকাপড় পরলে কেবল ছবিই সুন্দর হয় না, সালামির অংকও বাড়তে পারে! সকলেই পরিপাটি পোশাক পরে, আদবকায়দা জানে এমন বাচ্চাদের পছন্দ করে, বিশেষ করে সালামি প্রদানকারীরা।

সর্বকনিষ্ঠ সন্তানের সুবিধা:  তুমি যদি পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান হও, তাহলে তোমার জন্য সুখবর! বেশি সালামি পাওয়া তোমার জন্মগত অধিকার। বড়রা বলবেন, ‘ও তো এখনো ছোট, ওকে একটু বেশি সালামি দিতে হবে।’ তোমার বয়স ১৯ হলেও এই নিয়ম তোমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য!

ভাই-বোনদের সাথে দল বাঁধো (বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করো): সালামি সংগ্রহের সময় একসাথে থাকলে আত্মীয়রা খুশি হন। সালামি নেওয়ার সময় বলো, ‘আম্মু বলেছেন, আমরা একসাথে সালামি নিব।’ এই টেকনিক ফলো করলে সালামির অংক বাড়তে পারে। তবে যদি দেখো ভাই-বোনেরা বেশি পাচ্ছে আর তুমি কম, তাহলে একলা চলো রে! একটু বুদ্ধিমান না হলে সালামি সংগ্রহের যুদ্ধে জেতা মুশকিল।

পছন্দের জিনিসের ট্রিক: যদি কোনো চাচা বা মামা প্রশ্ন করেন, ‘বাবা, ঈদের জন্য কী চাও?’ কখনোই বোলো না, ‘আপনার দুআই যথেষ্ট।’ এই ভুল করা যাবে না! নিজের পকেটটা সালামি দিয়ে পূর্ণ করতে হলে বিনয়ের মিটারটা একটু কমাতে হবে। কৌশলে বলো, ‘চাচা, নতুন একটা বই/জামা/জুতা সেদিন অনলাইনে চোখে পড়েছে… দেখাব?’ তারপর দেখিয়ে দাও তোমার পছন্দের জিনিসগুলো। সেই চাচা বা মামা হয় তোমাকে ঐ জিনিসটা নিজেই কিনে দিবে অথবা কিনে নেওয়ার জন্য তোমাকে টাকা দিবেন। উইন-উইন সিচুয়েশন। 

ধাপ ২: সালামি সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে হও কৌশলী

‘আম্মু ব্যাংক’ থেকে বেঁচে থাকো: ঈদ সালামির সবচেয়ে বড় হুমকি হলো তোমার নিজের মা! তিনি বলবেন, ‘আমাকে দে, তোর কাছে থাকলে টাকা হারিয়ে যাবে, আমি তোর জন্যেই রেখে দিচ্ছি, তুই বড় হয়ে ভালো কিছু করিস… ইত্যাদি।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই টাকা তুমি আর জীবনে চোখে দেখবে না! এটা বাজার-সদাই, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল কিংবা তোমার বা ছোট ভাইয়ের স্কুলের ফি-তে খরচ হয়ে যাবে। তাই বুদ্ধি করে বলো, ‘আম্মু, আমি নিজেই বুদ্ধিমানের মতো জমিয়ে রাখছি!’

সালামির সিন্দুক: কখনোই টাকা যেখানে-সেখানে খোলা জায়গায় রেখো না! বাসা থেকে আত্মীয়রা চলে গেলে দেখবে কেউ না কেউ বলছে, ‘দেখি তো, কত সালামি পেয়েছ!’ কিছুক্ষণ পর দেখবে ৫০০ টাকার একটা নোট উধাও, এরপর ১০০০, এরপর…!

‘খুচরা’র ফাঁদে পা দিয়ো না: বড় ভাই বা বাবা বা চাচা বলতে পারেন, ‘১০০০ টাকার খুচরা আছে?’ বা ‘১০০ টাকার বদলে দুটো ৫০ টাকার নোট দিতে পারবি?’ এই ফাঁদে পা দিলে দেখবে, তোমার সালামি তরতর করে শেষ হয়ে গেছে! টাকার ম্যাজিক হলো একবার বড় নোট খুচরা করলে তা নিমিষেই খরচ হয়ে যায়।

ছোট ভাই-বোনের ফাঁদ থেকে সাবধান: ছোটরা কাঁদো কাঁদো মুখ করে তোমাকে বলবে, ‘তুমি তো বড় হয়ে গেছ, তোমার অনেক টাকা। এত টাকা দিয়ে কী করবে? আমাকে কিছু দাও।’ এভাবে তোমাকে অনুশোচনায় ফেলে তোমার কাছ থেকে কিছু টাকা আদায় করতে চাইবে। তাদের জবাব দিতে হবে, ‘ফিতরা ঈদের সালাতের আগে দেওয়া শেষ। আপাতত তোমাকে দান-সাদকা করতে পারছি না।’ তবে এক্ষেত্রে কিছুটা নরম হওয়া যেতে পারে। কিছু টাকা ওদের দিতে পারো। তোমারই তো ছোট ভাই-বোন ওরা, তাই না!

ধাপ ৩: বুদ্ধিমানের মতো খরচ করো (বা অন্তত চেষ্টা করো)

অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা এড়িয়ে চলো: হাতে টাকা আসতেই মাথায় হরেক রকম জিনিস কেনার চিন্তা ঘুরপাক খাবে। নতুন গ্যাজেট, ফাস্ট ফুড অথবা বই, পোশাক। কিন্তু মনে রেখো, একদিনের মধ্যে সব খরচ করে ফেললে এক সপ্তাহ পর অন্যরা যখন ঈদের সালামি নিয়ে ঘুরবে, তখন আফসোস করবে! এক্ষেত্রে মিতব্যয়ী ও সংযমী হতে হবে।

আত্মীয়দের সালামির অংক জানিয়ো না: আত্মীয়দের যদি একবার বলে ফেলো, ‘আমি ৩০০০ টাকা পেয়েছি!’—তাহলে পরবর্তী প্রশ্ন হবে, ‘এত টাকা দিয়ে কী করবে?’ এটা একটা ফাঁদ। এই ফাঁদে পা দিলে তারা তোমার কাছ থেকে দেখবে কীভাবে কীভাবে জানি সালামির টাকা গায়েব করে দিয়েছে। তাই তোমার উত্তর হওয়া উচিত, ‘কিছু গুরুত্বপূর্ণ দরকারি জিনিস কিনব।’ (কথাটা  মিথ্যে না। যে বইটা কিনতে চাচ্ছ, সেটা তোমার কাছে ঠিকই গুরুত্বপূর্ণ!)

বিনিয়োগ করো: বন্ধুরা মিলে নিজেদের সালামির টাকা কোনো ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারো বা নিজেরাই ছোটখাটো ব্যবসা দাঁড় করাতে পারো। ব্যবসা হলো সর্বোত্তম উপার্জন। ব্যবসায় লাভ হলে তোমার টাকার পরিমাণও বাড়বে (লস হলে কিন্তু টাকা কমে যাবে, এটাও মাথায় রাখতে হবে)।

দান-সাদাকা করো: এটাও এক প্রকার বিনিয়োগ। দুনিয়াবি না, এই বিনিয়োগ আখিরাতের জন্য। সাদাকা করলে আল্লাহ তোমাকে তা বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন। সেই সাথে সওয়াব ও আখিরাতে পুরস্কার তো আছেই। এতে অভাবীদের সাহায্য হবে। বন্ধুরা মিলে সালামির টাকা দিয়ে গরিব-দুঃখীদের নতুন জামাকাপড় বা ঈদের নাস্তার উপকরণ ও সরঞ্জাম কিনে দিতে পারো। এতে তারাও ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারবে।

সঠিক পরিকল্পনা করলে ঈদ সালামি বেশি আসতে পারে এবং বেশ কিছুদিন টিকতেও পারে! নিজেকে একটু আনন্দ দাও, তবে এতটা খরচ কোরো না যে, দুই দিন পর কারও কাছে ধার চাইতে হয়! মনে রেখো—ঈদের সালামি বছরে একবার আসে (একবার বলছি কারণ কুরবানির ঈদে তেমন কেউ সালামি দেয় না), কিন্তু উল্টাপাল্টা খরচের আফসোস অনেক দিন থাকে!

তোমার ঈদের সালামি পরবর্তী ঈদ পর্যন্ত টিকে থাকুক, এই আশা ব্যক্ত করে জানাই আগাম ঈদ মুবারক!

[ষোলো ঈদ সংখ্যা ২০২৫ এ প্রকাশিত]