- জুমানা মেহেদী ও রামীসা মেহেদী
শত শত ব্যস্ত মানুষের মাঝে স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে আছি আমি। পা দু’টো কাঁপছে, চোখের পানিতে নিকাব ভিজে যাচ্ছে। কাঁধের ব্যাগটি বুকের সাথে চেপে রেখেছি। কী করব, মন যে মানতে নারাজ। আজ যে শেষ রাত!
হয়তোবা এই স্থানে দাঁড়িয়ে কেঁদেছিলেন কোনো আলিম, কোনো শহীদ, কোনো সিদ্দীক, কোনো সম্রাট, কোনো দাস, অথবা আমার মতো কোনো এক সাধারণ তরুণী। তবে সকলের বাঁধভাঙা কান্নার রহস্য একটাই, বায়তুল্লাহর প্রতি ভালোবাসা। আল্লার ঘর ছেড়ে আসা যে কী কষ্টের, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। দেশে ফেরার সময় যতই ঘনিয়ে আসে, চোখে সমুদ্রের ঢেউ ওঠে, অন্তর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। যেন সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে হারালেও এত কষ্ট হতো না! আমার ইচ্ছে করে এখানেই বসে পড়ি, আরও অনেকটা সময় কাটিয়ে দিই কাবার প্রান্তে, তবে সেটা সম্ভব নয়। ফোনে কল আসছে।
ফোনের ওপাশে আব্বু, মাসজিদুল হারামেরই কোনো এক কোণ থেকে ফোন করেছেন।
‘আসসালামু আলাইকুম, আব্বু?’
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম, কোথায় তোরা?’
‘এই তো, মাতাফে ঈশার সালাত পড়লাম।’
‘আচ্ছা, বেশি দেরি করিস না। গাড়ি কিন্তু এসে পড়বে।’
‘আচ্ছা, দেখি।’
ফোনটা রেখে বিষণ্ণ মনে আবারও ফিরে তাকাই কাবার দিকে।
‘রব্বী, আমার তো যেতে ইচ্ছা করে না। প্লিজ আবারও আপনার ঘরের মেহমান হিসেবে ফিরে আসার তাওফিক দিয়েন, প্লিজ, প্লিজ।’ ভেজা চোখে আমার শেষ আবদারটা করেই ফিরে চলি। বেশি দেরি হলে না আবার গাড়িই মিস হয়ে যায়।
মক্কায় আমাদের শেষ রাতটা অনুভব করতে আজ ঈশার সালাতের পরে এজেন্সি থেকে একটা ছোটখাটো প্রোগ্রামের আয়োজন করা হবে। প্রোগ্রামের গাড়ি ধরতেই পা দু’টো টেনে টেনে বেরিয়ে আসি কাবা প্রাঙ্গণ থেকে। মাতাফে (কাবার ঠিক পাশের খোলা চত্ত্বরে) মাগরিব ও ঈশার সালাত পড়ায় বের হতে ভালোই দেরি হয়ে যায়। তবুও হাজারো মানুষের ভিড় ঠেলে হোটেলে পৌঁছাই। একটু ফ্রেশ হয়েই আট সিটের দু’টো মাইক্রো করে বেরিয়ে পড়ি আমরা। মক্কার প্রশস্ত রাস্তা ধরে এগিয়ে চলে গাড়ি। ডান-বাম করতে করতে শহর ছাড়িয়ে চলে আসি মক্কাকে আগলে রাখা পাহাড় সারির মাঝে। নতুন দেশের নতুন রাস্তা দিয়ে ঘুরতে তো ভালোই লাগছিল। বড়-প্রশস্ত স্থাপনা আর গুটিকয়েক মানুষ—বঙ্গভূমির সন্তানের জন্য অপরিচিত এক দৃশ্য। তবে পাহাড়ের উপর থেকে সাহস করে নিচে তাকাতেই আঁতকে উঠি আমি। সরু এক রাস্তা ধরে খাড়া বেয়ে চলছে গাড়ি। নেই কোনো আলো, নেই কোনো রেলিং। শুধু খাড়া খাঁদ পেরিয়ে হাজারো ফিট নিচে এক ক্ষুদ্র শহর।
সত্যি বলতে ভয়ই করছে আমার। যেই সর্পিল আঁকাবাঁকা পেঁচানো রাস্তা, একটু এদিক সেদিক হলেই তো ব্যাস! দুআ-দরুদ পড়ে মনে মনে সাহস জোগাই। কিছুক্ষণ পর সেটুকু সাহসও হারিয়ে সেখানেই থামবার সিদ্ধান্ত নিই আমরা। যাত্রীদের সবার শেষে পেছন থেকে নামি। তবে বেরিয়ে আসতেই যেন অসাড় হয়ে যায় হাত-পা। একে তো হাজার ফিট উপরে লিলিপুটই হয়ে গিয়েছি, তার উপর ঠান্ডা ঝড়ো হাওয়া আমাকে ঠেলে চলে পাহাড়ের ঠিক কিনারে। গুটি গুটি পায়ে কোনোমতে পাথরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াই। এবং তখনই সকল ভয়কে কাবু করে জায়গা করে নেয় একরাশ মুগ্ধতা।
চোখ মেলে দেখি ঘন কালো আকাশ, দানবাকার পাহাড় আর ঠিক তার মাঝের মুক্তার মতো ঝলমলে মক্কা নগরী। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি, হাজারো আলোর বিন্দুগুলো একত্রে এক চোখ ধাঁধাঁনো সৌন্দর্য তৈরি করেছে। তার কেন্দ্রে সাদা মার্বেল পাথরে আবৃত মাসজিদুল হারাম যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে চলছে আল্লাহর সকল বান্দাদের। ছড়িয়ে থাকা রাস্তা, হাজারো হোটেল, সুউচ্চ ক্লক টাওয়ার এবং বৃহৎ মাসজিদুল হারাম সব মিলিয়ে এক অদ্বিতীয় দৃশ্য! এ যেন মক্কার এক লুক্কায়িত সৌন্দর্য, যা অল্প কজনই উপভোগের সৌভাগ্য পায়। সুবহানাল্লাহ!
হঠাৎ কারও ডাকে সম্বিৎ ফিরে পাই। ঐ খানিকটা আলো-আঁধারে ফিরে দেখি খুব হাসিমুখে আব্বু হেঁটে আসছেন এক অপরিচিত লোকের কাঁধে হাত রেখে। কিন্তু এতটা আন্তরিকতার সাথে আব্বু আর উনি আসছেন যেনো তারা দুই ভাই, কিংবা হারিয়ে যাওয়া ভাইকে অনেক বছর পর খুঁজে পেয়েছেন। কাছে আসতেই আব্বু বললেন,
‘I want you to meet someone, he is a Palestinian.’
এবার যেন আরেক চমকের পালা! আব্বুর কথা শুনতেই আমি লোকটিকে ভালো করে দেখি। মাঝারি গড়নের সুদর্শন একজন ব্যক্তি, তবে তার চেহারা জুড়ে ছড়িয়ে আছে অভাবনীয় এক হাসি। যেন এই হাসি দিয়ে তিনি বিশ্বকে জয় করে নেবেন। আমরা সকলে তার দিকে বড় বড় চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছি। এ যেন এক সুপারহিরোকে পেশ করা হয়েছে আমাদের সামনে। পরমুহূর্তেই, আমি আল্লাহর প্রশংসা করি এবং ভাঙা ভাঙা আরবিতে বলি,
‘আমার স্বপ্ন ছিল এই পবিত্র ভূমিতে এসে আমি আমার কোনো ফিলিস্তিনি ভাই-বোনের সাথে সাক্ষাৎ করব।’
আমার মতো অনারবের আরবি তিনি বুঝে নেন এবং হাত মুঠো করে উচ্চ স্বরে আরবিতে বলে উঠেন,
‘ইনশাআল্লাহ, আমাদের দেখা হবে কুদস আশ-শারিফে।’
তার স্বরের এ দৃঢ়তা, প্রতিটি শব্দের বিশ্বাস আমাকে নাড়িয়ে দেয়। আসলেই এই ব্যক্তিদের অন্তর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও আল-কুদসের কথা মুছে ফেলা যায় না! আর তাই তো আল্লাহ তাদেরকে কবুল করে নেন মর্যাদাবান বান্দাদের মাঝে।
একের পর এক ঘটনায় বিস্মিত আমি কোনোমতে এগিয়ে চলি। এদিকে দেখি আমাদের টিমের আঙ্কেলরা পাথরের উপর বিছানো একটা বড় পাটিতে বসে আছেন, তাদের মাঝে সুতরাতে সাজানো হরেক রকমের ট্রেডিশনাল আরবি ডিশ। ব্যাপার কী! মুহূর্তের মধ্যে এত আয়োজন কোথা থেকে এলো! আমাদের না শুধু কিছু ‘আলবাইক’ খাওয়ার কথা ছিল?
জানতে পারলাম, এই কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনা গড়িয়েছে অনেক দূর। আমরা যেই স্থানে গাড়ি থামাই, সেখানেই ডিনার করছিলেন এই ফিলিস্তিনি ভাইসহ তার কিছু আরব বন্ধুরা। আমরা নামতেই তারা দাওয়াত করে বসেন, তারপর জোর করে তাদের সাথে পাটিতে বসিয়ে দেন। তবে যেই তারা দেখেন যে, এই গ্রূপে মহিলা সদস্য আছেন, তখনই তরিঘরি করে উঠে পড়েন এবং বলে যান,
‘তোমাদের খাওয়া হলে, এই স্থান তোমাদের মহিলাদের জন্য ছেড়ে দিয়ো।’
এরপর সকল খাবার-দাবার জিনিসপত্র রেখে হারিয়ে যান পাহাড়ের বাঁকে। আর তাদের আয়োজনের মাঝে রয়ে যাই আমরা। যেন এসকল আয়োজন তো আমাদেরই। সকলের খাওয়ার পরেও অনেক খাবার বেঁচে যায়। আর সেই খাবারও তারা দিয়ে দিতে চান, হোটেলে নিয়ে আবার খাওয়ার জন্য। এই অজানা কিছু আরব ভাইদের আন্তরিকতা দেখে মনে হয়, যেন তারা অপেক্ষাতেই ছিলেন যে কোনো মুসলিম ভাই এখানে আসবে আর তাকে আমরা খাবারে শামিল করব।
মরুর বুকেও এই হাড় কাঁপানো বাতাসের মাঝে পেরিয়ে যায় আমাদের সময়। আমি আবারও ফিরে তাকাই মক্কার দিকে, মাসজিদুল হারামের দিকে। অপলক চেয়ে ভাবি, আল্লাহর মেহমানদের বিদায়ের বেলায় স্পেশাল এক উপহার পাঠালেন আমার রব, যেন আমাদের অন্তর প্রশান্ত হয়ে যায়। তিনিই তো জানেন কত ভালোবাসা নিয়ে এ ভূমিতে আসি, কত বেদনা নিয়ে ফিরে যাই, আর কত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করি আবারও ফিরে আসার।
আচ্ছা, নুবুওয়তের আগে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন পাহাড় থেকে মক্কা নগরীকে দেখতেন, তাঁরও কি এরকম লোমহর্ষক অনুভূতি হতো? তিনিও কি পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকতেন এই পবিত্র ভূমির দিকে। হয়তো ভাবতেন, এই কাবার মহান রবকে নিয়ে। খুঁজে চলতেন সত্যপথের সন্ধানে।
আজ সেই কাবার রব তাঁর রহমতের ছোঁয়ায় আমাকেও অভিভূত করলেন। মক্কার বুকে কাটানো শেষ রাতটি এক অতুলনীয় স্মৃতিতে ভরিয়ে দিলেন! আলহামদুলিল্লাহ।