এটাই ছিল শহীদ আসিফের তোলা শেষ ছবি!

আসিফের মারা যাওয়ার দিনের ঘটনার সামান্য বর্ণনা দিচ্ছি।

আমাদের পরিকল্পনা ছিল আমরা সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে বাসা থেকে বের হব। সাড়ে ৯ টার দিকে আমার ঘুম ভাঙ্গে। ফোনটা হাতে নিতেই দেখি আসিফ কল করেছিল ৯:১৫ তে। আমি সাথে সাথে কল ব্যাক করলাম আসিফকে। 

কল দিয়ে বললাম, “ফোন দিয়েছিলি, কিন্তু আমি ঘুমাচ্ছিলাম।”

আসিফ বলল, “বের হবি না?”

“হ্যাঁ।”

“১০ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে কাওলা বাজারে আয়।”

“ঠিক আছে, তুইও আয়।”

আমি রিকশা নিয়ে সরাসরি কাওলা রেলগেট চলে গেলাম। রিকশা থেকে নেমে আসিফকে কল দিলাম, “কই তুই?”

আসিফ বলল, “আমি রিকশায় আসতেছি, তুই এয়ারপোর্টের সামনে চলে যা।” আমি এয়ারপোর্টের সামনে চলে গেলাম। ওখানে যেয়ে অনেকের সাথেই দেখা হলো। একটু পরে আসিফ চলে আসলো। আসিফের হাতে একটা শপিং ব্যাগ ছিল, যার মধ্যে এক বোতল পানি ও একটা ছাতা ছিল। আমি বললাম, “ছাতা আনছিস কেন?” আসিফ বলে, “আজকে অনেক রোদ, তাই ছাতাটা সাথে নিলাম।” (ভাবুন ছেলেটা কত সৌখিন ছিল!)

আমাদের ভার্সিটির আরও অনেকে আসতে বাকি ছিল। সেজন্য আমরা এয়ারপোর্ট স্টেশনের সামনের ফাঁকা জায়গাটাতে বাকিদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ফোনে ‘আসছি আসছি’ বলতে বলতেই প্রায় এক ঘণ্টা পার করে দিল বাকিরা। তবুও আমরা বাকিদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এই সময়ের মধ্যে আমরা কিছু ফেস্টুনও বানিয়ে নিয়েছিলাম। ফেস্টুন-এর মধ্যে কোনো প্রকার উস্কানিমূলক বা সরকারবিরোধী কথাবার্তা লেখা ছিল না। এমনকি স্লোগানের মধ্যেও না। আমাদের পরিকল্পনা ছিল আমরা সুষ্ঠুভাবে আন্দোলন করব এবং আন্দোলন শেষে যে যার বাসায় চলে যাব। আমরা যে শুধু নর্দান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ছিলাম তা না। আমাদের সাথে আশেপাশের স্কুল-কলেজের কোমলমতি ছোট ভাইয়েরাও ছিল।

এবার আসি মূল ঘটনায়।

আমরা যখন এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনের সামনে একত্র হচ্ছিলাম, আমাদেরকে দেখে রাস্তার পশ্চিম পাশের ফুটওভার ব্রিজের নিচ থেকে একদল পুলিশ আমাদের দিকে আসলো। আমরা বিচলিত না হয়ে তাদের আসার অপেক্ষা করলাম। তারা আসলো এবং আমাদেরকে বলল, ‘এখানে জড় হওয়া যাবে না।’ আমরা বললাম, ‘আমাদের আরও কিছু লোক আসতে বাকি। আমাদেরকে দশটা মিনিট সময় দেন।’ পুলিশ সময় দিল না। আমরা পাঁচ মিনিট চাইলাম, সেটাও দিল না। পুলিশ বলল, ‘আপনারা বিএনএস চলে যান, বাকিরা ওখানে চলে যাবে।’ পুলিশ আরও বলল, ‘আপনারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেন, পুলিশ আপনাদের সাথে আছে।’

পুলিশের এই কথা শুনে আমরা হল্লা দিয়ে উঠলাম। এক প্রকার আনন্দ উল্লাস বলতে পারেন। আমাদের কারও কারও কাছে লাঠি ছিল, পুলিশ সেগুলো ফেলে দিতে বললে আমরা ফেলে দিলাম। তখন মাননীয় বুজুর্গ পুলিশ সাহেবেরা আমাদেরকে রাস্তা পার করে দিল। আমরা চললাম উত্তরা বিএনএস-এর দিকে। আসিফ, আমি ও বাকিরা হাতে হাত ধরে চললাম গন্তব্যস্থলে। গন্তব্যস্থলে উত্তরার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছেলে-মেয়েদের আসার কথা। আমরা দূর থেকে দেখি ওরা ওখানে আছে।

আমরা ওদের সাথে মিলতে যাব এমন সময় পুলিশের অস্ত্রবহর গাড়ি থেকে আমাদের উপর অতর্কিত হামলা শুরু করে। কয়েক সেকেন্ড পর পর গ্রেনেড, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে থাকে (এয়ারপোর্টের সামনে পুলিশের আচরণ আর বিএনএস সেন্টারের পুলিশের আচরণ পুরোপুরি ভিন্ন ছিল)। এমন সময় সুসজ্জিত পুলিশ (খুব সম্ভবত ‘দাঙ্গা পুলিশ’ বলে তাদেরকে) সাহেবরা আসলো এবং আমাদের উপর গুলি বর্ষণ করতে শুরু করল।

আমাদের অনেকেই দলছুট হয়ে গেল। ঠিক তখনই আমার ডান হাতে একটা গুলি লাগে। আমরা স্থান ত্যাগ না করে অনেকেই ছিলাম পুলিশের গুলির সামনে। আসিফও ছিল আমার পাশে তখন। আমার গুলি লেগেছে সেটা আমি আসিফকে বলিনি। হঠাৎ একটা পুলিশের ছুড়ে মারা টিয়ারশেল আমার পাশে এসে পড়ল। তখন আমার চোখ-মুখ জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিল। আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল অনেক (আমার আগে থেকেই শ্বাসের সমস্যা ছিল)। আমার চোখে চশমা ছিল, তবুও আমি ঝাপসা দেখা শুরু করলাম। তখন অনেকেই আবার দলছুট হয়ে গেল। ওই ভিড়ের মধ্যে তখনই আমি আসিফকে হারিয়ে ফেলি। আমি আসিফকে অনেক খোঁজার চেষ্টা করেছি তখন, কারণ ও যেন আমাকে হসপিটালে নিয়ে যায়। আমার এই অবস্থা দেখলে ও যেভাবেই হোক আমাকে হসপিটালে নিয়ে যেত। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস আমি ওকে খুঁজে পাইনি। আমি তখন ফুটপাতের দিকে সরে গেলাম।

কত স্টুডেন্ট গুলিবিদ্ধ হয়েছে তখন সেটা ধারণার বাইরে! তখন একজন স্টুডেন্টের মুখের বাম চোয়ালে গুলি লাগে। সে কলেজ স্টুডেন্ট ছিল। মানুষ যেভাবে মুখভর্তি বমি করে, ঠিক সেভাবেই রক্ত বের হচ্ছিল তার মুখ দিয়ে। তখন এক অপরিচিত বাইকওয়ালা এসে আমাকে ও তাকে বাইকে উঠিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেলে নিয়ে গেল। বাংলাদেশ মেডিকেলে গিয়ে দেখি কোনো ডক্টরই আমাদেরকে চিকিৎসা সেবা দিবে না। দেখি বহু গুলিবিদ্ধ ও নানাভাবে আহত রোগী। ওখান থেকে একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে আমাদের পাঁচজনকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের দিকে রওনা দিল। অ্যাম্বুলেন্স যখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উপরে, তখন আসিফের সাথে শেষবারের মতো আমার কথা হয়।

আসিফ বলে, “তুই ঠিক আছিস ভাই?”

আমি তখন ওকে সব খুলে বলি। আমি বলি, “তুই ঠিক আছিস?”

আসিফ বলে সে ঠিক আছে। আসিফ বলে, “তুই হসপিটালে যা, চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হ। আমি আছি আন্দোলনে।”

আমি বলছিলাম, “সুস্থ হয়ে আবার আসতেছি, দেখা হবে।” কিন্তু দেখাটা যে এভাবে হবে আমি ভাবিনি।

এর মধ্যে আসিফের মেজোবোনের সাথে আসিফের কথা হয়। আসিফের বোন বলে ওখান থেকে সরে যেতে, কিন্তু তখনই একজন গুলিবিদ্ধ ভাই ‘পানি পানি’ করে চিৎকার করছিল। আসিফ ওর বোনকে বলে, ‘আপু, আপনি রাখেন, আমি ওই ছেলেটাকে পানি খাওয়াব।’ ধারণা করা হচ্ছে পানি খাওয়াতে গিয়ে ঠিক তখনই আসিফ নির্মমভাবে গুলিবিদ্ধ হয়, যেটা আপনারা অনেকেই দেখেছেন। ১২:৩০ -১:০০ টার মধ্যে আসিফ গুলিবিদ্ধ হয়।

আমি ঢাকা মেডিকেলে থাকা অবস্থায় জানতে পারি আসিফ আর নেই। সেখান থেকে এ পর্যন্ত আমি পুরো ট্রমার মধ্যে চলে গেছি, এখনো স্বাভাবিক হতে পারিনি। ও সব সময় বলত, ‘দেখিস, আমি জান্নাতে যাব, আমি জান্নাতে যাব।’ ওর মুখের কথা এভাবে বাস্তবে রূপ নিবে (ইনশাআল্লাহ), কখনো কল্পনাই করতে পারিনি। আসিফ ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, কলিজার বন্ধু। ও যে পরিমাণ কেয়ারিং ছিল, সেরকম কেয়ারিং আমার পরিবারের কেউ ছিল না। বন্ধুত্ব যে রক্তের সম্পর্কের ঊর্ধ্বে হতে পারে, সেটা আসিফের সাথে পরিচয় না হলে আমি জানতাম না।

ওর সম্পর্কে অনেক কিছুই লেখার আছে, সবাইকে জানানোর আছে ওর সম্পর্কে। লিখতে গেলে একটা মহাকাব্য হয়ে যাবে। যে অমূল্য রতন হারিয়েছি তা আর ফিরে পাব না। শুধু সবার কাছে একটাই অনুরোধ, ওর জন্য বেশি বেশি দুআ করবেন। 

[ঈষৎ সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত]