[ষোলো’র পক্ষ থেকে শহীদ আসহাবুল ইয়ামিনের বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন বন্ধু তনয় ও নাফিসের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাঈমুর রহমান ও আসাদুল্লাহ আল গালিব। সাক্ষাৎকারটির শ্রুতিলিখন করেছেন আয়াতুল্লাহ আল কাবীর।] 

ষোলো: আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। ভাই, কেমন আছেন আপনারা?

তনয়: ওয়া আলাইকুম আসসালাম। জি ভাই, আলহামদুলিল্লাহ। আপনাদের কী অবস্থা?

ষোলো: আলহাদুলিল্লাহ, ভালো। ভাই আপনাদের পরিচয়গুলো যদি একটু দিতেন, এক এক করে।

নাফিস: আমি এস এম নাফিস আহমেদ। আমি ইয়ামিনের সহপাঠী। আমরা প্রজেক্ট করতাম একসাথে। আর বিশেষ করে গতবছর আমরা একসাথে সবগুলো প্রজেক্ট করেছি। এবং এখানে আমরা সবাই নিজেদের ভাইদের মতো করে দেখি সবসময়। কারণ আমরা যে পুরা সময় একসাথে কাটিয়েছি—হলরুমে হোক বা অন্য কোথাও হোক—একসাথে কাটিয়েছি।

তনয়: আমার নাম শাফি সাদমান তনয়। আমি ইয়ামিনের ফ্রেন্ড। নাফিসের মতোই। আমরা চার বছর একসাথে কাটিয়েছি। আমরা হলে এক রুমেই থাকতাম। ও যখন শহীদ হইল, তার আগ পর্যন্ত আমরা একসাথেই ছিলাম। ইভেন যেদিন ও শহীদ হইল, তার দুইদিন আগেও রাতের বেলায় একসাথে আড্ডা দিলাম—রাত দুইটা-তিনটার দিকে, হলে। মানে এরকম ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলাম আমরা।

ষোলো: আপনারা দুইজনই MIST-এর CSE ডিপার্টমেন্টের, তাই না?

তনয়: জি, ভাই।

নাফিস: জি।

ষোলো: ইয়ামিন গতবছর জুলাইয়ে কোন ইয়ার, কোন সেমিস্টারে ছিল এবং তার তখন পর্যন্ত রেজাল্টগুলো কেমন ছিল?

নাফিস: ইয়ামিন আমাদের ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট ছিল। আমাদের তো প্রতি ইয়ারে ২টা করে সেমিস্টার থাকে। মানে স্প্রিং আর ফাইনাল। তো ইয়ামিন স্প্রিং টার্মে ছিল। মানে ফাইনাল ইয়ারের স্প্রিং টার্মে, প্রথম টার্মে ছিল। ওর রেজাল্ট ডিসেন্ট, মানে ফাস্ট ডিভিশন বলতে পারি। আমার একজেক্টলি জিপিএটা মনে নাই। থ্রি পয়েন্ট সামথিং হবে আরকি, ফাস্ট ডিভিশনেই ছিল।

ষোলো: যেহেতু, ইয়ামিন আপনাদের ফ্রেন্ড ছিল, আপনারা যেমন বললেন—ফ্রেন্ড কম, ভাই বেশি। তো তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আপনারা হয়তো একটু বেশিই জানবেন। আমরা জানতে চাচ্ছিলাম যে, সে ব্যক্তিজীবনে কেমন ছিল?

তনয়: আমরা অনেক সময় অনেক ফিকশনাল জিনিস নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি যে, একটা মানুষ কী পরিমাণ ভালো হইতে পারে? ইয়ামিন ওই রকমই একজন ছিল। আমি কয়েকটা উদাহরণ দিই, তাহলে আপনারা বুঝবেন। ধরেন, আমরা ফ্রেন্ডরা মিলে মাঝেমধ্যে মনোমালিন্য হয়, দেখা যায় অনেক সময় গালাগালিও হয়ে যায়। একজন গালাগালি করলে আরেকজনও গালাগালি করে। মানে এরকম একটা বাজে সিচুয়েশন হয়। ইয়ামিনকে কেউ একজন একটা খোটা দিয়ে কথা বলছে, একটা বাজে কথা বলছে, তাকে কখনো উল্টা রিপ্লাই বা বাজে কিছু বলতে দেখি নাই। মানে ও যথেষ্ট সহজ-সরল একটা মানুষ ছিল। আর সব থেকে বড় ব্যাপার হলো, ওর কোনো একটা ফ্রেন্ড বা দূর সম্পর্কেরও কেউও যদি কোনো বিপদে পড়ে, ইয়ামিন একদম লাস্ট পয়েন্ট পর্যন্ত থাকবে। মানে, ওটা একদম সলভ না করা পর্যন্ত। একটা জেদ থাকত তার মধ্যে। দেখা যাচ্ছে, যার প্রবলেম তার থেকে বেশি জেদ থাকত ইয়ামিনের। এরকম পরোপকারী মানুষ ছিল সে। তাছাড়া একাডেমিক অন্যান্য গুণাবলী যদি বলি, সেটা আসলে কম হয়ে যাবে। ও এডমিশন টাইমে মেডিকেলও চান্স পাইছিল। রংপুর মেডিকেল কলেজ। সাথে বুয়েটেও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পাইছিল। আমার জানামতে, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেও চান্স পাইছিল মেইবি। সম্ভবত ওখানে এপ্লাই করে নাই পরে। একটা মানুষের তিনটা ড্রিম জায়গাতে [চান্স] পেয়েও সেখানে পড়েনি। শুধু পলিটিকাল রিজনে। মানে MIST-তে আসছে শুধু একটা কারণে, MIST-তে কোনো পলিটিক্স নাই। একাডেমিক পড়ালেখা হোক কিংবা মানবিক গুণাবলি—সবকিছুতে ও বেস্ট ছিল আসলে।

নাফিস: তনয়ের সাথে আমি একটু এড করব যে, ও অত্যন্ত ধার্মিক ছিল। আমরা যখন অবসর সময়ে ইউনিভার্সিটির মধ্যেই থাকতাম, খেলাধুলা করতাম, অনেক সময় নামাজও কাযা হয়ে যেত। ইয়ামিন সবসময় আমাদের ধরে ধরে মসজিদে নিয়ে যেত নামাজ পড়তে। বলত, ‘নামাজটা পড়, নামাজটা কাযা করিস না’। এবং তনয় তো বললই যে, কোনোদিন ওর মুখ থেকে খারাপ কথা বের হয় নাই। সব সময় ভদ্রভাবেই চলেছে। ভদ্রভাবেই কথাবার্তা বলত। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, ও অত্যন্ত মেধাবী ছিল। ওকে গড গিফটেড বলব আমি। কারণ, আমরা হয়তো নতুন কোনো কিছু থাকলে সেটাকে ইনকমপ্লিট রাখি। কিন্তু ও কোনো কিছু জীবনে প্রথমবার শুনলেও, সেখানেও চমৎকারভাবে নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিত। যেকোনো প্রবলেম হোক, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে CSE-তে অনেক প্রবলেম থাকে, সেই প্রবলেমগুলোও অত্যন্ত চমৎকারভাবে সলভ করত। এবং এটাই তার অনেক বড় বৈশিষ্ঠ্য ছিল। সবাই তাকে এভাবেই চিনত যে, ইয়ামিন মানেই চ্যাটজিপিটি! আমরা এভাবেই বলতাম। কারণ, এমন কোনো প্রশ্ন ছিল না, যার উত্তর সে জানত না। … ও পলিটিক্স পছন্দ করত না। ওর চিন্তাভাবনা ছিল যে, পলিটিক্সটা সবার মাঝে থাকা উচিত। হইলে সবাই করবে, নাইলে কেউই করবে না। মানে পলিটিক্সকে কেউ নেগেটিভভাবে ইউস করবে, এই জিনিসটার প্রেক্ষাপটে ও কখনোই একমত ছিল না। যদি স্টুডেন্টদের কল্যাণের ব্যাপারে করা যায়, তবে অবশ্যই ও স্বাগত জানাত… 

ও অনেক সৎ ছিল। একটা এক্সাম্পল বলতে পারি, আমরা যখন ব্যাচেলর পড়াশোনা করছিলাম তখন আমরা অনেক সময় এসাইনমেন্ট হোক বা প্রজেক্ট হোক, আমরা অনেক সময় এআই-এর হেল্প নিতাম। মানে চ্যাটজিপিটির হেল্প নিতাম। যেটার বৈধতা-অবৈধতার দিকে যাব না, কিন্ত ইয়ামিন জানত ওকে কেউ প্রশ্ন করবে না, তাও ও কখনো চ্যাটজিপিটি ইউজ করেনি। সবসময় নিজেই সব আন্সার করত। কারণ ও বিশ্বাস করত যে, ওকে কেউ দেখুক বা না দেখুক, আল্লাহ ঠিকই দেখতেছে। এবং এই জিনিসটাই আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করত—না, আমরা যেটা করছি সেটা ঠিক না। আমাদের সৎ হওয়া উচিত এবং সঠিকভাবে চলা উচিত। আমরা এটা ওর কাছ থেকেই শিখছি। আমাদের জীবনের চারটা বছর একসাথে কাটিয়েছি, আমাদের সবসময় মনে হইছে যে, ইয়ামিন হচ্ছে পরিপক্ব একটা ক্যারেক্টার, যাকে ফলো করলে হয়তো আরও ভালো মানুষ হতে পারব। 

ষোলো: অনেক কিছুই যেটা ফ্যামিলি জানে না বা ফ্যামিলির সাথে শেয়ার করা হয় না, কিন্তু বন্ধুদের সাথে শেয়ার করা হয়। ইসলাম ও মুসলিমদের নিয়ে তার কোনো ভিশন কিংবা স্বপ্ন ছিল কিনা? এরকম কিছু নিয়ে আপনাদের সাথে কখনো আলোচনা হইছে কিনা?

তনয়: আমাদের মাঝে প্রায়ই এইগুলা নিয়া কথা হইতো। আমরা রুমমেট ছিলাম, দেখা যাইত যে তখন ইজরায়েল গাজাতে হামলা করছিল। এগুলা নিয়ে আমরা প্রায়ই কথাবার্তা বলতাম। মানে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। ও আসলে জীবন্ত উইকিপিডিয়া ছিল। সে আসলে সবকিছুরই খবর রাখত, সবকিছু নিয়েই জানত। দেখা গেছে যে, ইজরায়েলের গাজার উপর চলমান যে হামলা ছিল, ওগুলা নিয়ে অনেক খোঁজ রাখছিল… তাছাড়া ধরেন সৌদি আরব বা অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের যে কান্ট্রিগুলা আছে, ওদের বর্তমান যে অবস্থা ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে বা যেটা আসলে হওয়া উচিত ছিল—এগুলা নিয়ে আমরা প্রায়ই কথা বলতাম। ওর চিন্তাভাবনাটা ওরকমই ছিল। এসব জায়গাগুলা আসলে ওকে অনেক ব্যথিত করত। সত্যি বলতে, বিভিন্ন জায়গায় মুসলিমদের অধঃপতন ওকে অনেক ব্যথিত করত।

[সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত]