[ষোলোর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নাঈমুর রহমান ও আসাদুল্লাহ আল গালিব। শ্রুতিলিখন করেছেন আজিম মাহমুদ মিরাজ।]
ষোলো: আসসালামু আলাইকুম।
তাহসিন: ওয়ালাইকুমুস সালাম।
ষোলো: আপনার নাম?
তাহসিন: আমি মোহাম্মদ তাহসিন।
ষোলো: আপনি কী করেন?
তাহসিন: আমি স্টুডেন্ট।
ষোলো: কোথায় পড়ালেখা করছেন?
তাহসিন: মাদ্রাসা-ই বায়তুল মামুর-এর দশম শ্রেণির ছাত্র।
ষোলো: আপনার কখন মনে হলো আপনার জুলাই আন্দোলনে যাওয়া উচিত? কী অনুভব করছিলেন? কী দেখে মনে হলো আপনার এখন যাওয়া উচিত?
তাহসিন: অনেকে যাচ্ছে (আন্দোলনে), নিজেদের রক্ত দিচ্ছে। স্বৈরাচার সরকার আমার আব্বুকে অনেকবার গ্রেফতার করেছিল, তাই তার উপর আমার অনেক ক্ষোভ ছিল। এই জন্যেই আমার আন্দোলনে যাওয়া।
ষোলো: আপনি কত তারিখ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন?
তাহসিন: আমি ১৮ (জুলাই) তারিখ।
ষোলো: কোথায় যোগ দিয়েছিলেন?
তাহসিন: (মিরপুর) দশ নাম্বার।
ষোলো: আপনার অভিজ্ঞতা বলুন।
তাহসিন: ১৮ তারিখ এপাশ থেকে অনেকে আন্দোলনে গিয়েছিল। আমিও তাদের সাথে যোগ দিই। হঠাৎ দেখি পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়তেছিল। সবাই সরে যাচ্ছিল আন্দোলন থেকে। ১৯ তারিখ আমি এবং আমার ফুফাতো ভাই একসাথে ছিলাম। ১৯ তারিখেই একজনের বুকের বামপাশে গুলি লেগেছিল ময়লার ওইপাশে। এরপরে আমার আব্বু আর আমাকে যাইতে দেয় নাই কয়েকদিন। তারপর আব্বু কয়েকদিন ছিল না। কারণ আব্বুকে পুলিশ ধরতে আসছিল, তাই আব্বু কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। আব্বু ছিল না তাই আমি মাঝে মাঝে আন্দোলনে গিয়েছিলাম।
ষোলো: ১৮, ১৯ তারিখের পরে আবার কবে গিয়েছিলেন আন্দোলনে?
তাহসিন: ১৮, ১৯, ২০ তারিখ আন্দোলনে গিয়েছিলাম এবং ২১ তারিখ বেরিয়েছিলাম আন্দোলনে যাওয়ার জন্য, কিন্তু যাই নাই।
ষোলো: আপনার আন্দোলনে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছিল? কেন গিয়েছিলেন?
তাহসিন: আমি আন্দোলনে গিয়েছিলাম প্রথম কারণ শেখ হাসিনার পতনের জন্য। কারণ আমার পুরো পরিবার চাইতো সে যেন আর না থাকে। সে আমার আব্বুকে বহুবার গ্রেফতার করিয়েছিল। আর গিয়েছিলাম কোটার জন্য, কারণ আম্মু বলছিল এই কোটা থাকলে নাকি আমাদের চাকরি হবে না।
ষোলো: আপনি তো আন্দোলনে গিয়েছেন। দেখছেন, পুলিশ গুলি করছে, ছাত্রলীগের গুন্ডারা মারধর করছে। আপনি জানেন আপনি যেকোনো সময় আহত হতে পারেন বা মারাও যেতে পারেন। এত হতাহত দেখেও আপনি আন্দোলনে যাওয়ার সাহস কীভাবে জোগালেন?
তাহসিন: অনেকেই মরছিল আন্দোলনে। আর আমি মরলে তো কিছু হইত না। কারণ আমার আরও দুই ভাই আছে, তারা আমার আব্বু-আম্মুকে দেখবে। আর এটা (আন্দোলনে যাওয়া) তো কোনো খারাপ কাজ না। মরলে তো কেউ বলবে না যে, খুন করতে গিয়ে মারা গেছে। সবাই আরও আমাকে দেখে অনুপ্রাণিত হবে।
ষোলো: আপনি যেদিন আহত দিয়েছিলেন, সেদিনের ঘটনাগুলো আমাদের একটু বলবেন?
তাহসিন: ৪ আগষ্ট হয়তো দুপুর ১টার পর আমি অনেকের সাথে ১০ নাম্বারের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি পুলিশ এবং ছাত্রলীগ আসতেছিল, হাতে অস্ত্র নিয়ে। তখন ১০ নাম্বার বায়তুল মামুর মসজিদের গলিতে ঢুকে পড়ি। সেখানে আগে থেকে কিছু ছাত্রলীগের গুন্ডারা অপেক্ষা করছিল। তাদের দেখে অনেকে দৌড়ে চলে গেছে। একজন ভাইয়াকে অনেক মারছিল। এবং তার মানিব্যাগে অনেক টাকা ছিল, নিয়ে গেছে। আর আমি দৌড় দেওয়ার সময় আমার পায়ে কিছু একটা দিয়ে আঘাত করেছিল।
ষোলো: কী দিয়ে আঘাত করেছিল?
তাহসিন: কী দিয়ে আঘাত করেছিল তা মনে নেই। তবে অনেক ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। কেটে গিয়েছিল। তখন দৌড় দিতে দিতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। স্থানীয় লোকজন অনেকে আমার আব্বুর পরিচিত ছিল। তারা আমাকে আব্বুর দোকানে দিয়ে গিয়েছিল। দোকান বন্ধ পেয়ে আমায় বাসায় নিয়ে আসে। কয়েকদিন পরে চিকিৎসার জন্য হসপিটালে যাই।
ষোলো: আহত হওয়ার পরে সরকারের পক্ষ থেকে বা কোনো সংঘঠনের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পেয়েছিলেন?
তাহসিন: সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো সাহায্য পাইনি। অন্যান্য অনেকে ডিটেইলস নিয়েছে কিন্তু কোনো সাহায্য করেনি, শুধু আপনারাই করেছেন।[ফুটনোট- মাসরুরস গ্রুপের অনুদানে ৬০ জন আহতকে প্রায় ৯ লক্ষ টাকার আর্থিক সহযোগিতা করেছিল ষোলো ম্যাগাজিন।]
ষোলো: আপনি বাংলাদেশের তখনকার অবস্থা নিয়ে হাতাশায় ছিলেন, তাই আপনি আন্দোলনে গিয়েছিলেন। এখন বাংলাদেশের যে অবস্থা, আপনি যে পরিবর্তনের জন্য আন্দোলনে গিয়েছিলেন সে পরিবর্তনটা কি আপনি পেয়েছেন?
তাহসিন: অনেকটাই পেয়েছি। কারণ শেখ হাসিনা নেই, সবাই নিজের ইচ্ছেমতো যা খুশি করতে পারে। এখন আর আমার আব্বু-আম্মুর কারও কোনো ভয় নেই যে, পুলিশ এসে আব্বুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে।
ষোলো: আপনার আব্বুকে গ্রেফতার করার কি কোনো কারণ ছিল?
তাহসিন: আন্দোলনের আগে আওয়ামীলীগের লোকেরা আব্বুর কাছে চাঁদা চাইতে আসে। আব্বু তখন আর্মি বা র্যাব কাকে যেন ফোন করে তাদের ধরিয়ে দেয়। তারা তিন মাস জেলে ছিল। জেল থেকে বেরিয়ে এসে আব্বুর নামে মিথ্যা মামলা দেয় এবং আব্বুকে আটবার গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
ষোলো: ভবিষ্যত বাংলাদেশকে কীভাবে দেখতে চান? বাংলাদেশ নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
তাহসিন: ভবিষ্যত বাংলাদেশটা এমন চাই, যেন সবাই সবার অধিকারের কথা বলতে পারে। কেউ যাতে তাদের কিছু করতে না পারে। মেয়েরা যেন নিরাপদ থাকে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেন ছাত্র রাজনীতির নামে ছাত্রদের মধ্যে মারামারি বা কোনোরকম সংঘাত না হয়। সব জিনিসের দাম যেন কম থাকে। বর্তমানে অনেক পরিবার আছে মধ্যবিত্তের চেয়েও নিম্ন মধ্যবিত্ত। তারা তাদের সন্তানকে পড়ালেখা করাতে পারে না। তারা বিনামূল্যে পড়ালেখাসহ অন্যান্য যেসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত আছে, সেসব যেন পায়।
ষোলো: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য শুকরিয়া।