ধরো, তুমি একজন নভোচারী। মহাকাশ যানে করে মহাশূন্যে ভাসছো। পৃথিবীকে ঘণ্টায় ২৮,০০০ কি.মি. গতিতে প্রদক্ষিণ করছো। ভ্যাকুয়াম-সিল করা খাবার খেয়ে সাহরি-ইফতার করছো। এভবেই ঈদ এসে উপস্থিত! কিন্তু চারদিকে নিস্তব্ধতা, নেই কোনো হৈচৈ, নেই সুগন্ধ ছড়ানো বিরিয়ানি কিংবা পরিবারের উষ্ণ আলিঙ্গন। এতদিন সিয়াম রাখার পর তুমিও ঈদ উদ্‌যাপন করতে চাও, ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে চাও। কিন্তু ছোট্ট একটা সমস্যা আছে! ঈদের চাঁদ তো দেখা হলো না। চাঁদ কোথায়? তুমি তো রীতিমত চাঁদের উপরে আছো। এখন কী করবে? পৃথিবীর মানুষের চাঁদ দেখার ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করবে, নাকি একেবারে পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে নিজেই ঘোষণা দিয়ে দিবে, ‘ঈদ মুবারক!’

আসলে মুসলিম নভোচারীরা ISS1 থেকে বাইরে বেরিয়ে ‘ঐ দেখো চাঁদ! ঈদ মুবারক!’ বলার মতো সুযোগ পায় না। তাদেরও পৃথিবী থেকে ঘোষণা আসার অপেক্ষায় থাকতে হয়, ঠিক যেমন পৃথিবীর অন্য সবাই করে। মহাশূন্যে চাঁদের উপর থাকা সত্ত্বেও তারা বিশেষ কোনো সুবিধা নিতে পারেন না। সো স্যাড!

 চলো, জেনে নিই মহাকাশে সিয়াম এবং ঈদকেন্দ্রিক মজার মজার কিছু বিষয়-

আলোর গতিতে সিয়াম রাখা

পৃথিবীতে সিয়াম রাখার মানে হলো সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা। কিন্তু মহাকাশে? ISS প্রতি ৯০ মিনিটে একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, যার মানে নভোচারীরা দিনে ১৬ বার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখেন। যদি তারা সেই হিসেবে সিয়াম রাখতেন, তাহলে তাদের প্রতি ৪৫ মিনিট পরপর সাহরি-ইফতার করতে হতো। মজার না! কল্পনা করো, এই মাত্র খেজুর আর পানি দিয়ে ইফতার করলে। কিছুক্ষণ পরেই আবার সাহরি! বাস্তবে কিন্তু তা হয় না। তারাও আমাদের মতোই পৃথিবীর সময় অনুযায়ী সাহরি-ইফতার করেন। পৃথিবীর যে স্থান থেকে যাত্রা করেছেন সেখানকার সময় অনুসরণ করে সিয়াম রাখেন। কোনো শর্টকাট নেই! 

পানি ছাড়াই ওযু

জিরো গ্র্যাভিটিতে পানি ছিটানো মানেই তা উড়ে উড়ে অন্য কারও নাকে-মুখে চলে যাওয়া। তারা তখন জিজ্ঞেস করতেই পারে, ‘ভাই, তুমি কি ওযু করছো নাকি আমাকে গোসল করিয়ে দিচ্ছ?’ এজন্যই নভোচারীরা ভেজা তোয়ালে দিয়েই ওযু সেরে নেন। 

জিরো গ্র্যাভিটিতে[২] সালাত

পৃথিবীতে আমরা সালাতের জন্য কিবলার দিকে মুখ করে দাঁড়াই, তাই না? কিন্তু মহাকাশে? ISS এত দ্রুত চলে যে দেখা যাবে, তুমি মক্কার দিকে মুখ করে সালাত শুরু করেছ, আর সূরা আল-ফাতিহা শেষ হওয়ার আগেই হয়তো তোমার মুখ মঙ্গলগ্রহের দিকে ফিরে গেছে! তাহলে সমাধান কী? সমাধান একটাই, পৃথিবীর দিকে মুখ করে সালাত পড়ো, আর আশা রাখো যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমার সংগ্রাম বুঝবেন এবং সালাত কবুল করবেন। আর জিরো গ্র্যাভিটিতে সিজদাহ দেওয়া? ওটা তো অলিম্পিক লেভেল জিমন্যাস্টিকসের চেয়ে কম চ্যালেঞ্জিং না! 

ঈদের ভোজ

ঈদ মানেই আনন্দ, আর দারুণ-দারুণ সব মুখরোচক খাবার। কিন্তু মহাকাশের খাবার একটু আলাদা। ওখানে চিকেন চাওমিন নেই,  মচমচে সমুচা নেই, নেই গরম ধোয়া ওঠা বিরিয়ানি। আর ফিরনির তো প্রশ্নই ওঠে না! ওখানে নভোচারীরা ডিহাইড্রেটেড খাবার খান। খাবার থেকে পানি শুষে বের করে ফেলা হয়। সব খাবার থাকে ভ্যাকুয়াম-সিল করা কিংবা শুকনো গুঁড়ো আকারে, যেগুলো গরম পানি মিশিয়ে খেতে হয়। সেসব খেয়ে পৃথিবীর খাবারের স্বাদ নেওয়ার বৃথা চেষ্টা তারা করতেই পারেন। পেস্টের মতো ঐ খাবার মুখে দিয়ে জান-প্রাণ লাগিয়ে কল্পনা করলে হয়তো বিরিয়ানির স্বাদ পাওয়া যেতেও পারে। এটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমি কী জানি! আমি কি গিয়েছি নাকি কখনো মহাশূন্যে!  

মহাকাশে ঈদের আমেজ

দূরে থাকা আত্মীয়দের সঙ্গে জুমে ঈদ উদযাপন করা যদি তোমার কাছে কঠিন মনে হয়, তাহলে কল্পনা করো পৃথিবী থেকে ৪০০ কি.মি ওপরে একা ঈদ পালন করা কেমন হবে। তবু নভোচারীরা ঈদকে স্পেশাল করার চেষ্টা করেন। হয়তো তাদের সবচেয়ে ভালো স্পেসস্যুটটি পরেন, পরিবারকে ভিডিও কলে শুভেচ্ছা জানান, কিংবা একে অপরকে “ভাসমান কোলাকুলি” করার চেষ্টা করেন—যদিও শূন্য অভিকর্ষে আলিঙ্গন করাটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ! জিরো গ্র্যাভিটিতে ঈদের মজা অন্যরকম। ভাবো তো, সালামির টাকা একে অপরকে দেওয়ার সময় নোটগুলো যদি ভেসে ভেসে যেত, তাহলে কেমন মজা লাগবে? মজার ব্যাপার কী জানো? তুমি ঈদে বেশি খেলেও কেউ বুঝবে না, কারণ এখানে ওজন মাপার কোনো উপায় নেই!

তুমি কি মহাকাশে ঈদ উদযাপন করতে চাও?

মহাকাশে ঈদ উদযাপন মানে নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। চাঁদ দেখা সম্ভব না হলেও সমস্যা নেই, পৃথিবীর সময় অনুযায়ী সিয়াম রাখা ও ঈদ পালন করা যায়। পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থেকেও ঈদের দিন নভোচারীরা অন্যান্য নভোচারীদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেন। আর জিরো গ্র্যাভিটি বরং ঈদের মজাকে আরও বাড়িয়ে তোলে! আমাদের বেশিরভাগই হয়তো কখনো মহাকাশে ঈদ পালন করতে পারব না, কিন্তু এই ভাবনাটাই ঈদের মাহাত্ম্য বাড়িয়ে দেয়। দিনশেষে, ঈদ সবসময়ই ম্যাজিকাল! ঈদ যেখানেই হোক—পৃথিবীর বুকে, সমুদ্রের পানিতে, কিংবা পৃথিবী থেকে ৪০০ কিলোমিটার উপরে তারাদের মাঝে—এই দিনটা কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা আর একসাথে উদযাপনের দিন।

তাই এই ঈদে, একবার আকাশের দিকে তাকাও। কল্পনা করো, কোনো এক নভোচারী পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে মহাকাশে বসে ঈদ পালন করছে।

সবাইকে ঈদ মুবারক। ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক অনন্ত থেকে অসীম পর্যন্ত!


[ ১] International Space Station - আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন

[২] পৃথিবী তার চারপাশের সকল বস্তুকে তার নিজের দিকে আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণ বলকে অভিকর্ষ বা গ্র্যাভিটি বলে। গ্র্যাভিটির কারণেই পৃথিবীতে আমরা ওজন অনুভব করি। মহাশূন্যে এই আকর্ষণ খুব কম বা একেবারে নেই বললেই চলে। তাই সেখানে কোনো ওজন নেই, সবকিছু ভাসতে থাকে। একে জিরো গ্র্যাভিটি বলে।

[ষোলো ঈদ সংখ্যা ২০২৫ এ প্রকাশিত]